আমার মা আমার মূলধন

0
উদ্যোক্তা স্নিগ্ধা দত্ত তিথী

নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে স্নিগ্ধা দত্ত তিথী। বাবা একজন শিক্ষক, মা গৃহিনী। তিথী পরিবারের বড় মেয়ে, তার একটি ছোট ভাই আছে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। কাজপাগল তিথী যতো বড় হতে থাকেন, পাগলামোটা আরো বেড়ে চলে। প্রথম টিউশনি শুরু করেন যখন তিনি দশম শ্রেণিতে পড়েন। একটা মেয়ে তার বাসায় এসে পড়ে যেতো, মাস শেষে পেতেন ৫০০ টাকা। সেই ছিলো তার প্রথম উপার্জন।

উচ্চমাধ্যমিকে উঠে শুরু হলো অন্য একটা জীবন। একটা সরকারি সংস্থা থেকে ছয় মাস মেয়াদি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেন। তারপর সেই সংস্থাতেই ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পান। নিজের শেখাটাকে তখন আরো ভালো লাগে। ওখান থেকে তাকে সম্মানীও দেওয়া হতো।

তখনই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন উদ্যোক্তা হওয়ার। যদিও তখন তিনি কম্পিউটারের প্রজেক্টে ইন্টার্নশিপ করতেন এবং পাশপাশি টিউশনি করতেন, বিজনেসের পোকাটা মাথায় আসে মূলত নারীদের দেখে। তার কাছে আশেপাশের অনেক আন্টি আসতেন, তাকে বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে অনেক জায়গায় সার্ভে করতে হতো। সেখান থেকে কেস স্টাডি, রিপোর্ট তৈরি করতেন। তখন তিনি দেখেন সমাজে নারীদের কাজের খুব অভাব। তার মা একজন গুণী মানুষ। তিনি নানারকম হাতের কাজ, সেলাইয়ের কাজ জানেন। তার মায়ের কাজ দেখে অনেকেই বলতেন, দিদি আমরা যদি কিছু একটু জানতাম। স্নিগ্ধা তাদের সাথে কথা বলেন, তারা আসলে একদম খাঁটি বাংলার গৃহিনী। তাদের বাচ্চা একটা চকোলেট খেতে চাইলেও স্বামীর থেকে টাকা চাইতে হয়৷ নিজের শখ তো তারা ভুলতে বসেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে অনেকেই কাজ শিখে কিছু করতে চান। তাদের সাথে কথা বলে তিনি তার চিন্তাভাবনার বাস্তব রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন।

স্নিগ্ধার পরিবার ছিলো খুবই সাপোর্টিভ। তারা সবসময় তার সব কাজকে সমর্থন করেছেন, পাশে থেকেছেন। যখন যা করতে চেয়েছেন, তারা করতে দিয়েছেন। বিবিএ প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হুট করে একদিন তার মাকে বলেন, ‘মা আমি অনলাইন বিজনেস করবো’। মা বললেন, ‘এতে অনেক ঝুঁকি’। তিনি বললেন, ‘মা আমি পারবো’। মা বললেন, ‘আচ্ছা, করো’।

ব্যবসা করতে লাগে মূলধন, একটা সুন্দর পরিকল্পনা, যার কোনোটাই তার ছিলো না। তবে তিনি ক্লাস নাইন থেকে ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্রী হওয়ার এবং বিবিএ ও ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে পড়াশোনা করায়, এ বিষয়ে মোটামুটি জ্ঞান ছিলো। তাই সমস্যা নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট না করে, কাজে নেমে পড়লেন।

বাগেরহাটের মেয়ে স্নিগ্ধা । সেখানে আসলে তাঁতি কিংবা কাপড় তৈরির কিছুই নেই। তিনি গুগল, ইউটিউব, ফেসবুক থেকে সোর্সিং শুরু করলেন। দুইদিনের মধ্যে বেশ কয়েকটা সোর্স পেয়ে যান এবং কাজ শুরু করেন। একদম শূন্য টাকা পূঁজি নিয়ে তার উদ্যোগের যাত্রা শুরু। শুরুর দিনটাতে নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে কিছু শাড়ির ছবি স্টোরিতে দেন। তার ভাগ্যটা এতোই সুপ্রসন্ন ছিলো যে ওইদিন তার স্টোরি দেখে কয়েকজন নক করে জানতে চান বিজনেস শুরু করেছে কি না? সেলের জন্য কি না? তিনি জানান, হ্যাঁ। তার পরিচিত এক বড় আপু ওই দিনই একটা শাড়ি অর্ডার করেন। আর এভাবেই কিছুদিনের মধ্যে পেজ ওপেন করে আস্তে আস্তে সাজিয়ে-গুছিয়ে কাজ শুরু করেন।

তার উদ্যোগের শুরু থেকেই তার শক্তি ছিলো তার মা। প্রথম অর্ডার হলে মার কাছ থেকেই টাকা নিয়ে পণ্য এনে ডেলিভারি দেন। ডেলিভারি দিয়ে আসল টাকা মাকে দিয়ে, লাভের টাকাও মায়ের হাতে তুলে দেন, আলাদা করে রাখার জন্য। আর এভাবেই আজ অবধি তার উদ্যোগের পুরোটাই তার মায়ের জন্য এগোতে পেরেছেন। তিনি সবসময় বলেন, ‘আমার মা আমার মূলধন’।

স্নিগ্ধার উদ্যোগের লক্ষ্য ছিলো নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি নিজের একটা আলাদা পরিচিতি তৈরি করা। ১০-৫টার চাকরি, একঘেঁয়ে ধরাবাঁধা গণ্ডীবদ্ধ জীবন কোনোদিনই তার পছন্দ ছিলো না। উদ্যোক্তা স্নিগ্ধা প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখতেন তার একটা আকাশ হবে; যে আকাশ জুড়ে তার অবাধ বিচরণ থাকবে। যেখানে তিনিই তার রাজা।

নিজের উদ্যোগ সম্পর্কে উদ্যোক্তা বার্তাকে স্নিগ্ধা জানান, ‘স্বাধীনভাবে বাঁচাকে আমি বেঁচে থাকা বলে মনে করি। জীবনের স্বাদই যদি অনুভব করতে না পারলাম, তাহলে এ জন্ম বৃথা। তাই নিজের স্বপ্ন পূরণের পাশাপাশি আমার মাধ্যমে অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিই ছিলো আমার লক্ষ্য। যারা বলেছিলেন যে তাদের কাজের সুযোগ নেই, আমি এবং আমার মা তাদেরকে নিজের হাতে কাজ শিখিয়ে, তাদের তৈরি করার চেষ্টা করছি। আর যারা পারতেন তাদের পারাটাকে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ছোটবেলা থেকে একটা কথা খুব বিশ্বাস করি– মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে। ছোট থেকেই ১০ জনকে নিয়ে চিন্তাভাবনার একটা অভ্যাস গড়ে ওঠে। আর একটা সময় সেটা স্বপ্নে পরিণত হয়। আর সেই স্বপ্নের রূপ দিতে আমার উদ্যোগের যাত্রা শুরু’।

তার উদ্যোগে তিনি দেশীয় বিভিন্নরকম শাড়ি, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, উলের বিভিন্ন জিনিস, ব্লক, বাটিক, স্ক্রিনপ্রিন্ট শাড়ি, ড্রেস, তাঁতের শাড়ি, খাদি পাঞ্জাবি ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন। এগুলোর কারিগর তার সেই আন্টিরা। তার এই উদ্যোগের মাধ্যমে তিনি তাদের একটু হলেও সাহায্য করতে চেষ্টা করেছেন। বর্তমানে শাড়ি, ড্রেসের পাশাপাশি তিনি তার জেলা বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী নারকেল নিয়েও কাজ করছেন। নারকেলের বিভিন্নরকম পণ্য, নারকেল তেল, নারকেল খোল, ছোলা সবকিছুই বিদেশে রপ্তানি হয়। তিনি মাত্র আড়াই বছরে সাড়ে ১৫ লাখ টাকার বেশি পণ্য বিক্রি করেছেন।

উদ্যোক্তা স্নিগ্ধা দত্ত তিথীর জন্ম খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায়। বাগেরহাট সরকারি পি.সি কলেজে বিবিএ পড়ছেন৷ বর্তমানে তিনি একটা স্কুলে শিক্ষকতাও করছেন। পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। তার উদ্যোগের নাম ’প্রাচুর্য’ । তার স্বপ্ন ‘প্রাচুর্য’র মহিমা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ুক। তিথী স্বপ্ন দেখেন বাংলার নারীরা স্বাবলম্বী হবে, পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে নারীদের একটা স্বাধীন জগৎ তৈরি হবে । তার এই স্বপ্ন বাস্তব রূপ দিতে হয়তো অনেকটা সময় লাগবে। তবে তিনি বিশ্বাস করেন শুরু যখন করতে পেরেছেন, আজ হোক কিংবা কাল তার স্বপ্ন পূরণ হবেই।

সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা
,খুলনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here