সুবিধাবঞ্চিত নারীদের তৈরি পোশাকের প্রদর্শনী ও ফ্যাশন শো

0

আগ্রাসী নগরায়ণ ঢাকার আশপাশের নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর জীবনকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বেরাইদে বসবাস করা নিম্নআয়ের মানুষেরা এই পরিস্থিতির শিকার। এসব মানুষের অনেকেরই ভিটেমাটিছাড়া হওয়ার অবস্থা।

সাজেদা ফাউন্ডেশনের ‘সুদিন’ প্রকল্পের আওতায় সুবিধাবঞ্চিত নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বেরাইদ বস্তির নারীদের হাতের কাজ শেখানোর উদ্যোগ নেয় ‘পিরান বাংলাদেশ’ নামের একটি ফ্যাশন স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান। তাদের লক্ষ্য ছিল সৃষ্টিশীল কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া। আর এই উদ্যোগের নেপথ্যে ছিলেন পিরান বাংলাদেশের তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার জারিন তাসনীম জয়িতা ও তাঁর বোন নাযিফা তাবাসসুম পিউলি। পিরানের যাত্রা শুরু করোনাকালে। তারা দেশীয় কাপড় নিয়েই কিছু কাজ করে অল্প সময়ে ক্রেতাদের কাছে নিজেদের চাহিদার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

‘সুদিন’ প্রকল্পের জন্য জয়িতাকে প্রশিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। মাসব্যাপী এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করেন তিনি। মোট আটটি কর্মশালার মাধ্যমে কাপড়ের ধরন, অ্যাপ্লিক, রং ও ডিজাইন সম্পর্কে তাঁদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ চলাকালে আলোকচিত্রী রাফিদ আল জহুর পুরো সময়টা তাঁদের সঙ্গে থেকে ছবি তোলেন।

সেসব ছবি ও তাঁদের তৈরি পোশাক নিয়ে ১১ থেকে ১৪ আগস্ট ঢাকার ফরাসি সংস্কৃতিকেন্দ্র আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে অনুষ্ঠিত হয় ‘নিডল, থ্রেড অ্যান্ড আ স্প্ল্যাশ অব ওয়াটার’ শিরোনামের প্রদর্শনী।

বেরাইদের স্থানীয় ২২ জন নারী তাঁদের জীবনের গল্প বুনেছেন ১৫টি পোশাকের একটি ফ্যাশন সংগ্রহে। সেই সঙ্গে ছিল রাফিদ আল জহুরের তোলা স্থিরচিত্র। দেশীয় তাঁত, গার্মেন্টসের বাতিল কাপড় দিয়ে তৈরি হয়েছে নারী, পুরুষ ও শিশুদের পোশাক। পোশাকের জমিন অলংকরণে নারীরা তাঁদের পারিপার্শ্বিক ও যাপিত জীবনকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।

প্রশিক্ষণের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্রে নারীদের মুখেই শোনা যায় একেকটা ডিজাইনের গল্প; যেখানে উচ্চারিত হয়েছে তাঁদের সংগ্রামের কথা। উদ্বোধনী আয়োজনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ফ্যাশন হাউস স্টুডিও বিবিয়ানার প্রতিষ্ঠাতা লিপি খন্দকার, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক শেখ সাইফুর রহমান, সুপরিচিত মেকআপশিল্পী বাপন রহমান ও সাজেদা ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউসেফ বাংলাদেশেরও নির্বাহী পরিচালক আবদুর করিম।

লিপি খন্দকার বলেন, ‘আমরা চাই নতুন ডিজাইনাররা বেশি বেশি কাজ করুক। আমরা তাঁদের পাশে থাকতে চাই এবং সব রকম সহযোগিতা করতে চাই।’

শেখ সাইফুর রহমান ডিজাইনের প্রশংসা করে বলেন, পিরান বাংলাদেশের এই উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নিতে ডিজাইনকে টেকসই করতে হবে। এ ছাড়া এসব নারীকে আরও কাজে লাগানোর পরামর্শও দেন তিনি।

বাপন রহমান বলেন, এই অনন্য আয়োজনে নবীন ডিজাইনারদের কাজ দেখে তাঁর ৩৮ বছর আগে ফ্যাশন দুনিয়ায় পা রাখার স্মৃতি মনে পড়ে গেছে। ইউসেফের নির্বাহী পরিচালক আবদুর করিম এই প্রদর্শনীর আলোকচিত্রী রাফিদ আল জহুরের কাজের প্রশংসা করেন আর সেই সঙ্গে পিরানেরও। তিনি এই উদ্যোগকে টেকসই করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

গ্যালারিজুড়ে পোশাক ছাড়াও স্থান পায় নানা কিছু, যার সবই পুরোনো। নারীদের ব্যবহৃত শাড়ি দিয়ে একটি থিমেটিক কর্নার করা হয়। পোশাকগুলোর ডিসপ্লে করা হয় টিনের ওপর, যা বেরাইদের স্থানীয় অধিবাসীদের বসত নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। একটি কর্নারে দেখা যায়, কালো পলিথিনে মোড়ানো একটি পাত্রে পানিতে ভাসছে একটি হলুদ পোশাকের পুতুল। ঠিক তাঁর ওপরেই স্থান পেয়েছে একটি আলাকচিত্র। যেখানে বেরাইদের কোনো এক জায়গায় তোলা হয় একই পুতুলের ছবি।

সম্প্রতি ঝড় তোলা বার্বি মুভির একটা আবহ নিমেষে চোখের সামনে চলে আসে। একপাশে দেখা যায়, নিম্ন আয়ের মানুষের এলাকায় যে চায়ের টংদোকান, তাঁর একটি প্রতীকী আবহ। পুরো গ্যালারিতেই ছিল বেরাইদের যাপিত জীবনের ছোঁয়া। প্রদর্শনীর শুরু দিনই আয়োজন করা হয় ফ্যাশন শোয়ের। যেখানে বেরাইদের স্থানীয় অধিবাসীরাই অংশগ্রহণ করেন।

জীবনে প্রথম এমন একটি প্ল্যাটফর্মে পারফর্ম করতে পারার আনন্দ ছিল তাঁদের চোখে-মুখে। ডিজাইনার জয়িতা বলেন, ‘তেমন কোনো চিন্তা ছাড়াই আমার বোন পিউলি আর আমি পিরান বাংলাদেশ শুরু করি। ভাবিনি, এমন সাড়া ফেলবে। এই আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথিসহ সবার আগ্রহ আরও অনুপ্রাণিত করছে ভবিষ্যতে কাজ করার। আমি খুবই আশাবাদী।’

নবগঙ্গা স্টুডিওর সহপ্রতিষ্ঠাতা আলোকচিত্রী রাফিদ আল জহুর জানান, তিনি ফ্যাশন ফটোগ্রাফার নন; ডকুমেন্টরি আলোকচিত্রের মাধ্যমে মানুষের জীবনকে তুলে আনতে ভালোবাসেন। বেরাইদের মানুষের জীবনকে ফুটিয়ে তোলাই ছিল তাঁর লক্ষ্য।

পিউলি বলেন,‘এই প্রকল্পের পেছনে দারুণ সব মানুষ কাজ করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এটা মূলত ভালো টিমওয়ার্কের একটা ফল।’
প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিন ছিল সংগীতায়োজন। আলোকচিত্রের সঙ্গে ফ্যাশন সংগ্রহের প্রদর্শনী ও সেই সঙ্গে মোহ আর রণপার গান দর্শনার্থীদের নিয়ে যায় অন্যতর এক জগতে।

এই আয়োজনে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল ক্যানভাস ও হাল ফ্যাশন। এ ছাড়া সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল ‘গিজমো স্টুডিও’ ও আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ। প্রদর্শনীটি ১১ আগষ্ট শুরু হয়ে শেষ হয় ১৪ই আগষ্ট।

ডেস্ক রিপোর্ট,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here