সিল্কসিটির মানবতার ফেরিঅলা আসাদুজ্জামান জুয়েল

0
উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামান জুয়েল

ছোটবেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসতেন আসাদুজ্জামান জুয়েল, পাশাপাশি  লেখালেখিও। দুই বছর আগে সামাজিক পাতায় ‘অংশু’ নামে একটি গ্রুপ চালু করেন। লক্ষ্য ছিলো বন্ধুরা যে লেখালেখি করছেন তা সকলের সামনে উপস্থাপন করা। এতে একে অপরের কাজগুলো দেখার সুযোগ হবে, পাশাপাশি অন্যরা অনুপ্রেরণা পাবেন। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব, তখন তিনি এবং তার বন্ধুরা মিলে পরিকল্পনা করলেন সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তারা দুঃস্থ এবং মেহনতী ৫০০ পরিবারকে উপহার সামগ্রী দেবেন। এভাবে দুই মাসে ৫০০ পরিবারের হাতে এবং তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ মাস এক হাজার পরিবারকে সহায়তা উপহার তুলে দিয়েছেন তারা। শীতের প্রকোপ বাড়লে এক হাজার মানুষকে কম্বলও দিয়েছেন তারা। পরবর্তী বছরগুলোতে সংখ্যা বাড়িয়ে চার হাজার কম্বল উপহার হিসেবে দিয়েছেন।

এরপর তিনি চিন্তা করলেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একটি করে লাইব্রেরির ব্যবস্থা করবেন। বন্ধুরা মিলে আলাপ-আলোচনা শেষে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় আটটি ও শহরে তিনটি লাইব্রেরি গড়ে দিলেন। এখন প্রতিবছর ১০ থেকে ১২টি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে ৫০০ করে বই দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রেখেছেন। এছাড়াও এতিম বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করছে অংশু পরিবার। একটি এতিমখানায় পাকা ঘর তুলে দিয়ে তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে কম্পিউটার, হাতের কাজ, ড্রয়িং প্রশিক্ষণ এর ব্যবস্থা করেছেন।  বিধবাদের সেলাই মেশিন, কাপড়ের দোকান করে দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন অনেককে। এখন পর্যন্ত ৩০০ পরিবারকে হাঁস, মুরগী, ছাগলের খামার করে দিয়েছেন। তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতিমাসে বিভিন্ন স্থানে ৫০টি করে টিউবওয়েল উপহার দেওয়ার জন্য।

অংশু পরিবারের মানবিক এই উদ্যোগে উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামান জুয়েলসহ মূল শক্তি ৩০ জন বন্ধু। তারা ফান্ড গঠন করে কাজগুলো করে থাকেন। তাদের নেতৃত্ব দেন জুয়েল। অংশুর মানবিক কার্যক্রমে ৩০ বন্ধুর পাশে আরো অসংখ্য মানুষ এগিয়ে এসেছেন এবং আসছেন।

অংশু’র সব থেকে বড় স্বার্থকতা এখন পর্যন্ত অংশু ২২ জন ভিক্ষুককে স্বাবলম্বী করেছে। আসাদুজ্জামান জুয়েল প্রমাণ করেছেন তারাও উদ্যোক্তা হতে পারেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ২২ জন ভিক্ষুক আজ ভিক্ষাবৃত্তি বাদ দিয়ে অংশু পরিবারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়েছেন। তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে দেখার স্বপ্ন ছিল সিল্কসিটির স্বপ্নবাজ তরুণ আসাদুজ্জামান জুয়েলের। অনেকে মনে করেন, তার মহৎ চিন্তা ভাবনাকে শ্রদ্ধা করে নামের আগে ‘সিল্কসিটির মানবতার ফেরিঅলা’ শব্দ তিনটি জুড়ে দিলেও যেন কম হয়ে যায়।

উদ্যোক্তা বার্তাকে জুয়েল বলেন, “আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা আমরা এতিমখানার পাশাপাশি বৃদ্ধাশ্রম গড়বো, যা হবে আধুনিক। বিশাল জায়গা জুড়ে এটি করার পরিকল্পনা রয়েছে যাতে ভেতরে পুকুর, সবজি খেত সব থাকবে। সেখান থেকে সংগ্রহ করে তারা রান্না-বান্না করে খেতে পারবেন। এছাড়াও তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে অংশুর একটি ঠিকানা খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অংশুর নিজস্ব ঠিকানা বা একটা অফিস নিলে সেখানেও কিছু খরচ আছে। তাই অন্যভাবে উপস্থাপন করা যায় কিনা যেখানে আমাদের একটা ঠিকানাও থাকলো, পাশাপাশি এখান থেকেও কিছুটা অর্থ আসলো এমন চিন্তা থেকে নগরীর গণকপাড়ায় ১০ জুন ২০২২ অংশু গ্রন্থকুটির প্রতিষ্ঠা করি। ১৫ জুন সেখানে ক্যাফেটেরিয়াও চালু করি। আমি বলবো বই নিয়ে ভাবার আলাদা একটা জগৎ সৃষ্টি হয়েছে এখানে।”

অংশু গ্রন্থকুটিরে বিভিন্ন প্রকাশনীর বই রয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের বই যা রাজশাহীতে খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য সেগুলো সহজেই বইপ্রেমীরা পেয়ে যাবেন অংশু গ্রন্থকুটিরে। বই পড়ার পাশাপাশি কিনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে। কোন বই না থাকলে তিনদিনের মধ্যে ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার নিশ্চয়তাও দেন তারা। এখানে প্রতিটি টেবিল সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে খাবার রয়েছে চাইনিজ এবং মেক্সিকান। সাথে রয়েছে নাচোস, বার্গার, বিভিন্ন ধরনের চা-কফি ইত্যাদি। খাবারের দামও তুলনামূলক কম।

পরিবারসহ সাধারণ মানুষ, লেখকদের বিভিন্ন গ্রুপ, বিভিন্ন সংগঠন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী সকলে আসছেন অংশু গ্রন্থকুটিরে। বাচ্চাদের খেলার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা আছে। বাচ্চাদের ইচ্ছায় অসংখ্য পরিবারকে এই দুইমাসে বারবার আসতে হয়েছে। অংশুর নিজস্ব পাঠচক্রও রয়েছে যার কার্যক্রমও এখানে চলে। এখানে সহযোদ্ধা রয়েছেন ১৭ জন। এখানে লন্ডন থেকে পড়াশোনা করা স্টুডেন্ট যেমন রয়েছেন, ইঞ্জিনিয়ার রয়েছেন; তেমনই নগরীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাও আছেন যারা পার্টটাইম কাজ করে তাদের হাত খরচ চালিয়ে নিতে পারছেন।

এছাড়াও অংশুর নিজস্ব প্রকাশনী রয়েছে। ২০১৯ সালে ‘পলাতক’ নামে আসাদুজ্জামান জুয়েল-এর একটি বই প্রকাশ হয়েছে। এরপর আরও অনেক লেখকের বই। আগামীতে অংশু প্রকাশনীতে এমন বই ছাপানো হবে যেগুলো কম লাভ দেখে অন্যরা ছাপায় না কিন্তু সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। যেমন হেরিটেজ, বিভিন্ন প্রবন্ধ এবং পর্যটন নিয়ে বই।

সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথেও অংশু সম্পৃক্ত। বিভিন্ন জাতের পাখি রক্ষা করতে মাঝিসহ সকলকে সচেতন করা, দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করার মতো কার্যক্রম তারা পরিচালনা করে থাকেন। অনেক তরুণই তাদের এই কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসছেন।

উদ্যোক্তা আসাদুজ্জামান জুয়েল এর ছেলেবেলা কেটেছে সারদা পুলিশ একাডেমিতে। পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়াশোনা করেন তিনি। একটি ব্যাংকে চাকরিও করেছেন বেশকিছু বছর। পরবর্তীতে লেখালেখি, বিভিন্ন মানবিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে আসেন এই উদ্যোক্তা। তার এগিয়ে যাবার পথে বিরাট ভূমিকা রাখছেন সহধর্মিণী সুমেরা জাহান। স্বামীর এমন কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দেন, পাশাপাশি নিজে স্বাবলম্বী হওয়ায় পরিবারকেও সাপোর্ট করছেন। অংশু পরিবারের একজন সদস্য হওয়ায় তিনিও কন্ট্রিবিউট করে থাকেন।

এভাবে পরিবার, বন্ধুমহল সকলের সহযোগিতায় চলছে অংশু পরিবারের মানবিক, সামাজিক এবং নিজস্ব উদ্যোগ।

তামান্না ইমাম,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here