রোববারের সকালটা কি আপনার প্রতি সপ্তাহে কাঁচা বাজারে যেতে গিয়ে দিনটি পার হয়ে যায়? আপনি যখন ঢাউস ঝোলা নিয়ে বাজার করতে ছোটেন, তার অনেক আগে কাকডাকা ভোরে এক দল ছেলে-মেয়ে প্রতি রোববার এদিক-ওদিক ছোটে কাঁধে ক্যামেরা নিয়ে, লেন্স গুছিয়ে। সকালটা অন্যরকম শুরু হয় তাদের। এরকম লেন্স রাইডারদের নিয়েই আজকে উদ্যোক্তা বার্তায় আপনাদের বলবো একজন উদ্যোক্তার গল্প।
কলকাতায় ফটোওয়াকের (Photowalk) আয়োজন করেছিলো ডিএসএলআর (DSLR-Digital Showcase of Lense Riders) নামে একটি সংস্থা। এটা তাদের চতুর্থ ইভেন্ট এবং কলকাতায় ওই সংস্থার প্রথম ইভেন্ট। আর মোহিত-অঙ্কিতদের হোয়াটস্ ইউর স্কিলের (Whats ur Skill) স্পন্সর।
হোয়াটস্ ইউর স্কিল নামটায় একটা চ্যালেঞ্জ আছে যে সেটা অ্যাকসেপ্ট না করাটাই হেরে যাওয়া। এখনকার সময়ে মানুষ নতুন শখের ক্যামেরা কিনে দারুণ সব ছবি তুলছে। ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে, ট্যুইটারে তুলে দিচ্ছে। মেয়ের ছবি, ঘরের দেয়ালে মেয়ের আঁকা নানা রঙের ঢেউ খেলানো কারুকার্য। এরকম আরো কত নানা রকমের ছবি, আর তাই শত শত লাইক পাচ্ছে।
গত বছর ২৬শে মার্চ হাওড়া ব্রিজের কাছে মল্লিক ঘাট ফুলের বাজারের ভেতর যে পালোয়ানদের ঘাট আছে সেখানে তাদের পৌঁছাতে হবে সকাল ৬ টায়। ইভেন্ট শুরু হবে সকাল সাড়ে ছটায়। নির্ধারিত দিনে ফটোওয়াকের আয়োজনে গিয়ে দেখা গেলো যারা এই আয়োজনে উপস্থিত হয়েছে তাদের গড় বয়স চব্বিশ।
সেই আয়োজনে একজন তো এতোটাই উত্তেজিত ছিলো যে ভোর সাড়ে চারটা থেকে অপেক্ষা করেছে সকালের প্রথম আলোয় হাওড়া ব্রিজের ছবি তুলবে বলে। ফুল বাজারের লোকজন তাকে দেখে ক্ষ্যাপাই ভাবছিলো। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ক্যামেরা কাঁধে সগোত্রের লোকজন চলে আসায় এ যাত্রায় সামলে নিয়েছে। শুধু সামলে নিয়েছে বললে ভুল হবে দল বেঁধে যখন লেন্স রাইডাররা এলেন তখন রীতিমত গোটা ঘাট, ফুলের বাজার দখল করে নিয়েছে তারা।
একটু একটু করে পিঠের ব্যাকপ্যাক থেকে বের হলো তার নিজস্ব প্রেমের কামান। দূর পাল্লার সব লেন্স। নদীর এপাড় থেকে হাওড়া স্টেশনের গম্বুজের মাথায় বসে থাকা ছোট্ট পাখিটাকেও সে ফুল ফ্রেমে দেখতে পায়। ততক্ষণে ওখানে জড়ো হয়ে গিয়েছেন শখানেক মুহূর্ত-সন্ধানী লেন্স রাইডার। দিল্লি থেকে এসেছেন মোহিত তেজপাল, বেনারস থেকে এসেছেন নিশান্ত পাণ্ডে, সৈয়দ ওয়াসি হায়দর। গোটা টিমকে নেতৃত্ব দিতে সেনাপতি হিসেবে হাজির হন আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত ফটোগ্রাফার অভিষেক দাস।
এভাবেই হোয়াটস্ ইউর স্কিল আপনার ভিতর লুকিয়ে থাকা অবদমিত শিল্প সত্ত্বাকে খুঁচিয়ে দেয় আর একটা কমিউনিটি তৈরি করে আপনার নিঃসঙ্গতা ঘুচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এসবের মধ্যে দিয়েই উঁকি দেয় লুকোনো প্রতিভা। ওরা আপনাকে নিত্য নৈমিত্তিক প্রতিযোগিতার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আরো ভালো আরো অসাধারণ কিছু করার অনুপ্রেরণা দেয়। আপনি যদি পারেন তাহলে আপনি জিততেও পারেন পুরস্কার। ২০২০ সালে এই কাজটা করার জন্যেই উঠে পড়ে লেগেছেন কলকাতার ছেলে রোহিত কেডিয়া। রোহিত পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। কেপিএমজিতে কাজ করেছেন। পুনেতে একটি সংস্থায় উঁচু পদে চাকরি করেছেন। সৃজনশীলতা এবং উদ্যোগের দুনিয়া সব সময়ই উদ্যোক্তা রোহিতকে টেনেছে।
উদ্যোক্তা রোহিত বলেন, ২০১৪ সালে প্রথম যখন আইডিয়া খেলে আমার মাথায় তখন আমি কলকাতার বাইরে। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির শহর কলকাতা ছেড়ে পুনেতে থাকার সময় এই শহরের প্রাণশক্তিকে টের পেয়েছিলেন উদ্যোক্তা। শুরুটা একটা অসম্ভব প্যাশনের মধ্যে দিয়ে হয়েছিলো। ডোমেনের কী নাম হবে সেটা ঠিক করতেই রাত শেষ করে দিয়েছিলাম আমি আর আমার বন্ধু নিখিল। পাঁচশটা নামের মধ্য থেকে নামটা বাছা হয়েছিলো, হোয়াটস্ ইউর স্কিল। আমরা চারটি বিভাগে ভাগ করেই কাজটা শুরু করি। ফটোগ্রাফি, আঁকা, গ্রাফিক্স আর কনটেন্ট।
কলকাতায় ভাই অঙ্কিত কেডিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয় হোয়াটস্ ইউর স্কিলের বাণিজ্যিক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করার। ইতোমধ্যেই হোয়াটস্ ইউর স্কিলে ৩৫ হাজারেরও বেশি সৃজনশীল মানুষ এই সংস্থায় রেজিস্টার করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এখন ২৫টি বিনিয়োগকারী ক্লায়েন্ট আছে।
উদ্যোক্তা রোহিত এবং অঙ্কিত দুজনেই বললেন, তাঁদের সংস্থার মত ভূভারতে আর কোনো সংস্থা নেই যারা শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতির জন্য এভাবে বাণিজ্যিক মঞ্চ তৈরি করে দেন।
কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করলেও সংস্থার দুই প্রতিষ্ঠাতাই বললেন, সাফল্য কিন্তু প্রথমেই কলকাতায় আসেনি। এখানকার সদস্যরা তাদের নিজ নিজ রাজ্যে যে তৎপরতার সঙ্গে সহযোগিতা পেয়েছেন তার বিন্দুবিসর্গও কলকাতা পায়নি। যেমন উত্তরাখণ্ড পর্যটন দফতর তাদের প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই লুফে নিয়েছে। উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ে পাহাড়ে ছবি তোলার ওয়ার্কশপ করিয়েছেন তারা। সরকারিভাবে দারুণ সাড়াও পেয়েছেন। কেরালাতেও সাড়া পেয়েছেন দুর্দান্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বুঝিয়ে উঠতেই জুতোর সোল ক্ষয়ে গেছে। তবুও কলকাতা কলকাতাই। এই শহরেই একটা ছোট্ট গ্যারাজ ঘরে শুরু হয়েছিল কর্মকাণ্ড। তিন জনের একটা ছোট্ট টিম। কিন্তু সেই টিমে কোনো টেকনিক্যাল এক্সপার্ট না থাকায় ওয়েবসাইট তৈরির কাজ একটি সংস্থাকে দেওয়া হয়। ২ মাসের বেশি সময় নষ্ট করে গোটা প্রজেক্টটাই ঝুলিয়ে দেয়। আরেকটি অসুবিধে হল কলকাতার শিল্পীদের মধ্যে এখনও ডিজিটাল সচেতন না হওয়ার মাশুল গুনতে বাধ্য হচ্ছেন দুই কেডিয়া ভাই।
গোটা দেশে তাই ছড়িয়ে পড়াই একমাত্র বাঁচার পথ ছিলো। আর সেটা করতেই হোয়াটস্ ইউর স্কিল দাঁড়িয়ে গেল। ইভেন্ট যেমন চলছে তেমনি তার পাশাপাশি ছবি আঁকার চাহিদা। পাশাপাশি বিজ্ঞাপন তো আছেই। এমনকি তাদের পোর্টালটি রীতিমত শিল্পের, ফটোর বাজার খুলে দিয়েছে। এখন অপরিচিত অথচ অসাধারণ শিল্পীর আঁকাও উপযুক্ত মূল্য পাবে। রোহিতের এই সোনায় বাঁধানো আইডিয়া তৈরি করেছে একটা দুর্দান্ত টিম। রোহিতের সাফ কথা- আইডিয়া শেষ কথা নয়, আসল ভেলকিটা দেখিয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বেছে নিয়ে আসা এই টিমটা। অঙ্কিত, ওম, অভিষেক, মোহিত, নিতিন, নয়না, রাকেশ, পায়েল আর কৌশিক। এই টিমের স্পিরিটটাই ওদের প্যাশনকে সাফল্যে রূপান্তরিত করেছে।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)