ছোটবেলা থেকেই রান্নার প্রতি তার একটা ভালো লাগা কাজ করতো শেখ সানিয়ার। খুব আগ্রহ নিয়ে বিভিন্ন রান্নার অনুষ্ঠান দেখতেন। মনে মনে ভাবতেন, ‘যদি আমিও এভাবে টিভিতে গিয়ে রান্না শেখাতে পারতাম!’ ২০১১ সালে টিভিতে একটা রান্নার প্রশিক্ষণ দেয়া প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেখেন সানিয়া। প্রতিষ্ঠানটি তার বাসার কাছেই ছিল। বাসায় রান্না শেখার ইচ্ছা পোষণ করায় কেউই রাজি হয়নি। ‘রান্না আবার শেখার কি আছে?’, বলে তাকে রান্না শেখার ইচ্ছা বাদ দিতে বলা হয়। সানিয়া কথাটা মানতে রাজি ছিলেন না। কী করা যায়, সেটা ভাবতে থাকেন।
একদিন বাসায় বলেন, ‘অফ টাইমে আমি কিছু টিউশন পড়াবো। এতে করে আমার জ্ঞানের চর্চাটা হবে’। প্রথমে কেউ রাজি হয়নি, পরে অনেক বুঝিয়ে রাজি করালেন। কারণ বাসায় অর্থনৈতিক কোন প্রকার সমস্যা ছিলো না। শুরুতেই দুইটি টিউশন নেন। তিন মাসে কিছু টাকা জমিয়ে পরিবারে অমতে একটি তিন মাস মেয়াদি রান্নার কোর্সে ভর্তি হন এবং কোর্সটি কমপ্লিট করেন।
যে দুইটি টিউশন নিয়েছিলেন, সানিয়ার পড়ানোর ধরণ তাদের অনেক ভালো লাগে। ছাত্রদের প্রোগ্ৰেস দেখে তাদের অভিভাবকরা আরো দুইটি টিউশন দেন। হাত খরচ ও রান্নার কোর্সের টাকা টিউশন থেকেই হয়ে যেতো। ধীরে ধীরে বাসায় জানতে পারে যে, তিনি বাইরে রান্না শিখছেন। বাসার লোকজন তাকে অনেক বোঝান এবং বকাও দেন। কিন্তু কিছুতেই তাকে দমাতে পারেন নাই। এভাবে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে তিনি প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। শুধু রান্না না, ব্লক-বাটিক, সেলাই, এমবয়ড্ররি সহ আরও বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
সেলাই শিখে বাসায় অর্ডার নিতেন। এভাবে বেশ ভালোই চলতে লাগলো। সেলাই এবং টিউশন এসব শুধু রান্নার প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্যই করতেন। এরপর নিজের রান্না বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দেয়ার কথা মাথায় এলো। ২০১৬ সালে কয়েকটি দোকানে নিজের খাবারের স্যাম্পল দিলেন। তার খাবার সবার কাছে খুব প্রশংসিত হলো। তিনটি দোকানে প্রতিদিন খাবার ডেলিভারি দেয়া শুরু করলেন। প্রথম দোকানে রোল, পুডিং ও সমুচা, দ্বিতীয় দোকানে শুধু বিরিয়ানি এবং তৃতীয় দোকানে র্বাগার, স্যান্ডউইচ ও শর্মা দিতেন।
প্রথম দিকে কোন কর্মী ছাড়া সব একাই করতেন। বাসার সবাই অনেক রাগ করতেন তার কাজগুলো দেখে। তাও তিনি কাজ বন্ধ করেননি। মাকে অনেক বোঝাতেন, ‘আমি নিজের বিজনেস করতে চাই, নিজের দক্ষতায় দাঁড়াতে চাই। টাকার সাপোর্ট লাগবে না শুধু মেন্টালি সাপোর্ট করে আমার পাশে থাকো’। স্বল্প পুজি আর জ্ঞান নিয়ে একাই নামলেন। বাসার কোন সাপোর্ট পেলেন না। তার কাজ দেখে আপনজনেরা অনেক উপহাস করতো। কাজ বন্ধ করার কথাও বলতো। কিন্তু তাতেও তিনি থেমে থাকেনি। নিজের উপর দৃঢ় বিশ্বাস ও চোখে সফল হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই এগিয়ে চলেন।
সাল ২০২০। মনের ভিতর বাসনা এলো, একটা ছোট রেস্টুরেন্ট নেয়ার। কিছু জমানো টাকা ছিল সেটা নিয়েই নামলেন আর চালু করলেন ‘মাসহুর সুইটস এন্ড ইস্পাইসি’। ৩-৪ মাস খুব ভালোই চললো। কিন্তু করোনা কালীন সময়ে বারবার লকডাউন দেয়ায় রেস্টুরেন্ট কিছুদিন বন্ধ রাখলেন, কিন্তু বাসা থেকে খাবার ডেলিভারি ও অনলাইন ডেলিভারি চালু ছিলো। করোনা পরবর্তী সময়ে আবারও পূর্ণ উদ্যমে যাত্রা শুরু করলেন।
২০১৭ সালে শেফ কোর্স এবং ২০২০ সালে কুকিং লেভেল ১, ২ ও বেকিং লেভেল ২ সম্পন্ন করেন। বর্তমানে লেভেল ৪ এসোসার পার্ট ও লেভেল ৫ ট্রেনিং পার্ট চলমান। শিগ্রই দুই পার্টের জন্য একইসাথে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত শেফ কোর্স সহ ৪৫টি রান্নার কোর্সের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন । তিনি বাংলা, ইন্ডিয়ান, থাই, এ্যারাবিয়ান, মোগলাই, চাইনিজ, স্ন্যাকস আইটেম, মিষ্টি, পিঠা, ফাস্টফুড, জুস আইটেম, চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
মোঃ গোলাম হোসেন এবং রেশমা বেগম দম্পতির একমাত্র সন্তান উদ্যোক্তা শেখ সানিয়া। জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার লালবাগে। ২০১০ সালে আজিমপুর গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন । ২০১২ সালে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। তারপর কয়েক বছর পড়াশোনা বন্ধ ছিলো। ২০১৮ সালে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে অর্নাস পাশ করেন।
স্বপ্ন দেখেন নিজের রান্না ও রেস্টুরেন্টের সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার। নিজের উপর আর নিজের কর্মের উপর বিশ্বাস রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান। উদ্যোক্তা হবার যাত্রায় অনেকেই অনেক কথা বলেছে, কারোর কোন কথায় প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে এগিয়ে গেছেন। সানিয়া মনে করেন লক্ষ্য ঠিক রেখে শ্রম ও ধৈর্যের এই প্রচেস্টার যাত্রাতেই সাফলতা পেয়েছেন।
সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা