উদ্যোক্তা- জনাব মো: ওলি উল্লাহ

যে সময় অন্যসব বাচ্চাদের মতো তার খেলাধুলার বয়স ছিলো, সেসময়টায় না খেলে তিনি নিবিড় দৃষ্টিতে দেখতেন যন্ত্রপাতি-কলকব্জার কাজ। গানবাজনার শব্দের চাইতে লোহালক্কড়ের টুংটাং শব্দেই নাকি মুগ্ধ হতেন তিনি। হ্যাঁ কথা বলছি ওলি উল্লাহকে নিয়ে। যার আদিনিবাস কুমিল্লার দেবিদ্বারে হলেও নদী ভাঙ্গনে সব হারিয়ে জেলা পরিবর্তন করে চলে আসেন চুয়াডাঙ্গায়। প্রচন্ড অর্থ কষ্টে দিনমজুরের কাজ করেছেন। গায়ে-গতরে খেটে কোন রকম পার করেছেন দিন। শুরু করেন মেকানিকের কাজ। বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্ক শপে কাজ করেছেন প্রায় ৪ বছর। বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরী করা দেখতেন এবং একবার দেখলেই হুবহু বানিয়ে ফেলতে পারতেন তরুণ ওলি। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে সাহস করেন নিজেই দিবেন এমন ওয়ার্ক শপ। মাত্র ৪ হাজার টাকা আর নিজ অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চুয়াডাঙ্গা জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন তার উদ্যোগ ‘জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং’। পেছনে ফিরে আর তাকাতে হয়নি তাকে, হয়ে ওঠেন কৃষির আধুনিকায়নে এক প্রথিতযশা উদ্যোক্তা জনাব মো: ওলি উল্লাহ।

বিশেষত কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের গ্রামীণ কৃষকদের নিকট স্বল্পমূল্যে ব্যবহার ও পরিবেশ বান্ধব আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের পথচলা শুরু। প্রথমে খুলনা এবং বরিশাল বিভাগে হলেও প্রতিষ্ঠানটি এখন প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সারা দেশ ব্যাপি তাদের সেবা কার্যক্রম অব্যহত রেখে চলেছে।

আমদানি নির্ভরশীলতা হ্রাস, দক্ষ জনশক্তির সদ্ব্যবহার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের ক্রমবর্ধমান কৃষি পন্যের চাহিদা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন ও গবেষনায় নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। প্রতিষ্ঠানটি অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান স্বরূপ জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছে। বিসিক প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে কাজ করে চলেছে এবং সেই সাথে প্রতিষ্ঠানটির সার্বিক মঙ্গল কামনা করছে। বিসিক তার সেবার মাধ্যমে প্রত্যাশা করে যে অচিরেই প্রতিষ্ঠানটি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে একদিন আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), চুয়াডাঙ্গা জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং কে ক্ষুদ্র শিল্প খাতে নিবন্ধন প্রদান করেছে। জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং এর নিবন্ধন নম্বর: ৪০১৮২৩৯৯৪৭-ক্ষুদ্র-০০০২-২০২০ । দেশের মাঝারি, ক্ষুদ্র, ও কুটির শিল্পের নিবন্ধন প্রদান বিসিকের নিয়ন্ত্রণ মূলক কর্মকাণ্ডের একটি অন্যতম সেবা। বিসিকের নিবন্ধনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান সরকারী বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রাপ্তিসহ বিসিক কর্তৃক বিভিন্ন সেবার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার পেয়ে থাকবে।

জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত উদ্যোক্তা ওলি উল্লাহ বলেন, ” বলা যায় বাংলাদেশের ৮০ভাগ মানুষ কৃষির সাথে জড়িত এবং সেই কৃষিকে পুঁজি করেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু যখন লক্ষ্য করলাম আমাদের কৃষক ভাইদের খুব কষ্ট হয় একটা উপযুক্ত যন্ত্রের অভাবে তখন থেকেই আমার চেষ্টা ছিলো কিভাবে সেই যন্ত্র গুলো আমি দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরী করতে পারি। বিদেশ থেকে কিছু যন্ত্র আসে আমাদের দেশে কিন্তু সেটার দাম কৃষক ভাইদের নাগালের বাইরে এবং পাওয়াটাও বেশ ঝামেলার। তাই নিজ উদ্যোগে আমার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কৃষি কাজের প্রায় সকল ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরী শুরু করি”।

উদ্যোক্তা ওলি উল্লাহ মূলত শস্য বপণ থেকে মাড়াই এবং সেগুলো প্রসেসিং করা যাবে এমন প্রায় ২৫ ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরী করেন। বাজারে যে যন্ত্রের দাম ১২-১৫ লক্ষ টাকা জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং তথা ওলি উল্লাহ সেটি ৬-৭ লক্ষ টাকা মধ্যে তৈরী করে ক্রেতার হাতে তুলে দেন। পরবর্তীতে যন্ত্রের ত্রুটি দেখা দিলে নিজ দ্বায়িত্বে তার প্রতিষ্ঠান সেটি সারিয়ে দেন। তার ক্রেতাদের নিকট খুব আস্থার এক জায়গা তার প্রতিষ্ঠান ‘জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং’। তার তৈরী যন্ত্র ব্যবহারকারীরা জানান বিদেশি সেই মেশিনগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয় বরং বাড়তি কিছু সুবিধা থাকে ওলির তৈরী মেশিনে লাস্টিংও খুব ভালো করে।

শুধু যন্ত্র তৈরীই নয়, তিনি প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে ট্রেইনিং দিয়েছেন ৪৫ টি কর্মশালার মাধ্যমে। তার হাত ধরে অসংখ্য ওয়ার্ক শপ গড়ে উঠেছে তার বিভাগ সহ সমগ্র বাংলাদেশে। অনেক ওয়ার্ক শপের মালিক আছেন যারা একটি সময় তার প্রতিষ্ঠানের কর্মী ছিলেন। তার এসব কৃতিত্বের জন্য বর্ষসেরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রাপ্ত হন এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে।

সেবা গ্রহীতা ও ক্লাইন্টদের সাথে দীর্ঘমেয়াদী শক্তিশালী সর্ম্পক স্থাপন, উদ্ভাবন ও আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে উন্নত সেবা সরবরাহে বদ্ধপরিকর তিনি। উদ্যোক্তা বিশ্বাস করেন, সেবা গ্রহীতাদের সাথে তাদের সম্পর্ক আস্থা ও সম্মানের। সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন, ও নতুনত্ব সেবা নিয়ে তিনি ব্যবসায়ের সকল ক্ষেত্রে সততা, ন্যয়পরায়নতা ও ব্যবসায়িক মূল্যবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন।

বিপ্লব আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here