ঐতিহ্যবাহী মাদুর শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কাঁচামালের অভাব এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া এবং সস্তা বিকল্পের প্রাপ্যতা সাতক্ষীরার এক সময়ের সমৃদ্ধ ‘মাদুর শিল্প’ এখন বিলুপ্তির পথে।
সাতক্ষীরায় এক সময় গ্রামাঞ্চল ও শহরের মানুষদের বসার অন্যতম মাধ্যম ছিল মাদুর। অতিথি আপ্যায়নসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে মাদুরের ব্যবহার ছিল লক্ষ্যণীয়। তবে এখন আর খুব বেশি দেখা যায় না মাদুর। অধিকাংশ কারিগররাও ছেড়ে দিয়েছেন এ পেশা। কারণ আধুনিকতার ছোয়া লেগেছে সর্বত্র। আর সেই ছোয়ায় বদলে গেছে দৃশ্যপট। এমনকি নিত্য নতুন ব্যবস্থাপনা হারিয়ে দিয়েছে মাদুর শিল্পকে।
কিছু সংখ্যক মানুষ বাপ-দাদাদের পৈত্রিক ব্যবসার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এখনও আকড়ে ধরে আছেন মাদুর তৈরির পেশা। অনেক মাদুর কারিগর এ পেশা পরিবর্তন করছেন। কিন্তু দু’দশক আগে এ ব্যবসাটি খুবই জমজমাট ছিল এবং সাতক্ষীরা থেকে মাদুরগুলো সারা দেশে সরবরাহ করা হতো।
সাতক্ষীরার সুলতানপুর বোরো বাজারের পাইকারী ব্যবসায়ী কাওছার আলী প্রায় ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসায় জড়িত আছেন। তিনি বলেন, ‘প্লাস্টিক মাদুর বাজারে আসার কারণে মেলে মাদুরের চাহিদা কিছুটা কমে গেছে’
তিনি বলেন, একটি মাঝারি আকারের প্লাস্টিক মাদুর বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা, সেখানে একটি মেলে মাদুরের দাম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। যে কারণে মেলে মাদুর উৎপাদন করে তেমন লাভ হচ্ছে না। ‘মানুষ মূলত সস্তার প্রাপ্যতার দিকে ঝুকে পড়েছে।’
আশাশুনি উপজেলার বড়দল ও বুধহাটা বাজার মাদুরের হাটের জন্য বিখ্যাত। প্রতি রোববার বড়দলে, শুক্রবার ও সোমবার বুধহাটা বাজারে বসে মাদুরের হাট। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদুর কারিগররা প্রতি সপ্তাহে তাদের তৈরি মাদুর হাটে এনে পাইকারি ও খুচরাভাবে বিক্রি করেন। এরপর সেখান থেকে মাদুর চলে যায় খুলনা, যশোরসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায়।
আশাশুনি উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামের নব্বই শতাংশ পরিবার ২ হাজার দশকের গোড়ার দিকে মাদুর উৎপাদনের সাথে জড়িত ছিল। স্থানীয়রা জানান, এই সংখ্যাটি এখন হ্রাস পাচ্ছে এবং বর্তমানে মাত্র কয়েকটি পরিবার এই ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে।
বর্তমানে মাদুর উৎপাদন করে হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার। তাদের একজন গোবিন্দ মন্ডল (৫৫) জানান, মাদুর উৎপাদনে কাচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মেলে ঠিকমত পাওয়া যায় না। সামান্য যা পাওয়া যায় তার দাম অনেক বেশি। তিনি বলেন, এক জোড়া বড় সাইজের মাদুর তৈরি করতে খরচ হয় ৫০০ টাকা। আর বাজারে বিক্রি ৬০০ টাকা। সারা দিনে দুই জোড়া অর্থাৎ চারটি মাদুর উৎপাদন করলে ২০০ টাকা লাভ হয় তা দিয়ে সংসার চালানো খুবই দুরূহ।
একই উপজেলার যদুয়ারডাঙ্গী গ্রামের তারাপদ মন্ডল (৬০) জানান, তারা চার পুরুষ ধরে মাদুর উৎপাদন করেন। কয়েক বছর আগেও মাদুর উৎপাদন করে খুলনার পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও কয়রা মোকামে বিক্রি করতো। এলাকায় ব্যাপক হারে চাষ করা হতো মেলে। বর্তমানে মেলে চাষ না হওয়ায় মাদুর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আগে সপ্তাহে ২০০ থেকে ২৫০ জোড়া মাদুর তৈরী হতো। সেখানে বর্তমান সপ্তাহ জুড়ে ৮ থেকে ১০ টি মাদুর তৈরি হচ্ছে। ফলে মেলে সংকটরে কারণে এ শিল্প প্রায় বিলপ্তির পথে। টিকে থাকতে এ গ্রামের অনেক মানুষ এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।
সাতক্ষীরা শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি নাসিম ফারুক খান মিঠু বলেন, সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী মাদুর শিল্প বর্তমানে চরম সংকটে পড়েছে। এই পেশার সাথে জড়িয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করতো আজ তারা খুবই মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। যদি তাদের ঋণ সহায়তা লাগে তাহলে সে ব্যবস্থা করতে হবে তা না হলে সাতক্ষীরা থেকে অতিস্বত্তর এ শিল্প বিলপ্তি হয়ে যাবে।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা