তরুণ উদ্যোক্তা- মরিয়ম মনি

বিরূপ পরিস্থিতিতেও থেমে থাকেননি দেশের নারী উদ্যোক্তারা। যাঁরা নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার ভূমিকায় নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন। এমন একজন নবীন উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনের গল্প আজ তুলে ধরা হচ্ছে। গ্রামের বাড়ি টাংগাইলে তবে বেড়ে ওঠা গাজীপুরে। ছোট বেলা থেকেই মরিয়ম মনি খুব কাছ থেকে তাঁর পরিবারকে দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করতে দেখেছে।

উদ্যোক্তার গ্রামের বাড়ি টাংগাইলে তবে বেড়ে ওঠা গাজীপুরে।ছোট বেলা থেকেই মরিয়ম খুব কাছ থেকে তাঁর পরিবারকে দারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করতে দেখেছে।

মনি কুটির –এর প্রতিষ্ঠাতা মরিয়ম মনি। পরিবারে তার বাবা-ই ছিল একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। কিন্তু তার বাবার পক্ষে একা পুরো পরিবারের খরচ চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছিল। মা টেইলারিং এর কাজ করে সাধ্য মতো চেষ্টা করতো সংসারে কন্ট্রিবিউট করে সন্তানদের কে ভালো ভাবে মানুষের মতো মানুষ করার। উদ্যোক্তা মরিয়ম বলেন- “এতো অভাবের মধ্যে ও পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পেরেছি, এর পিছনে আমার মায়ের অবদান অনেক। আমাদের দুই বোনের পড়াশোনা ও আমাদের আবদার পুরোনের সব রকম চেষ্টা করতেন আমার মা। প্রায় ঈদে দেখতাম আমাদের নতুন জামা কিনে দিতো আমার মা-বাবা। কিন্তু নিজেরা কিছুই নিতো না। তখন আমার খুব খারাপ লাগতো।ভাবতাম কবে বড় হবো, কবে মা-বাবাকে একটু সচ্ছল দেখতে পাবো। আমাদের পরিবার আর্থিক ভাবে অসচ্ছল ছিল ঠিকিই তবে মানসিক শান্তি ছিল অফুরন্ত। আমার বাবা অসম্ভব কেয়ারিং পার্সন। আমাদের দুই বোনকে অসম্ভব ভালোবাসে আমার বাবা।”

উদ্যোক্তা জীবনের শুরুর কথা বলতে গিয়ে উদ্যোক্তা বলেন- “সাজতে ও সাজাতে আমার সব সময় ভালো লাগতো। তাই ঠিক করলাম বিউটি পার্লারে কোর্স করবো। কোর্স করতে অনেক টাকার দরকার।যেখানে আমাদের বাসায় নূন আনতে পানতা ফুরাতো সেখানে নিজের শখ পুরোন করা আমার পরিবারের পক্ষে অসম্ভব।

তাই আমি ২০১৩ সালে এস.এস.সি পরিক্ষার পর এলাকার একটি সমিতিতে জব নেই খুব সামান্য বেতনে। বেশি দিন জবটা করতে হয়নি। কোর্সের টাকা কিছুটা জমিয়ে আমার এলাকার এক পার্লারের মালিকের সাথে যোগাযোগ করি। সেখানে গিয়ে পরিচিত হই একজন মহান হৃদয়ের অধিকারী এক মহীয়সী নারী শ্রদ্ধেয় মমতাজ জামান শিপন আন্টির সাথে।আমার দেখা একজন অসাধারণ ভালো মানুষ। কিছু এডভান্সড করে আমি সেই কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলাম, কাজ শেখার প্রবল আগ্রহ থাকায় দ্রুত কাজ শিখে নিলাম। সেই পার্লারের আন্টি আমার কাজ দেখে ভালোবেসে কোর্সের বাকি ফী টা আর নিলেন না।বরং আমার পরাশোনার খরচ বাবদ প্রতি মাসে কিছু টাকা দিতেন।ভালোই কাটছিলো আমার দিনগুলি পরাশোনা ও পার্লারের কাজ“।

উদ্যোক্তা ২০১৫ সালে এইচ.এস.সি শেষ করার পর, পার্লারের আন্টির কাছ থেকেই উৎসাহ হয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন।কিছুদিন পর মরিয়ম পার্টনারশিপে একটি পার্লারের ব্যবসা শুরু করেন। পার্টনারের কিছু অসুবিধার কারনে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে হয়। পরবর্তীতে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার পর আবার আরেকটি পার্লারে চাকরি নেন ভার্সিটির খরচ চালানোর জন্য। এই পার্লারের স্বত্বাধিকারী উদ্যোক্তা মরিয়ম কে কাজের ফাঁকে পরাশোনা করার জন্য সময় দিতেন।

উদ্যোক্তা মরিয়ম ২০১৮ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।হাজবেন্ডের সহযোগিতা পেয়ে আবার চাকরি শুরু করেন একটা এনজিওতে।

কিছুদিন পরে করোনার কারণে মরিয়ম ও তাঁর হাজবেন্ড চাকরিহীন হয়ে পরেন। বাসা ভাড়া জমতে থাকে। বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এই বিপর্যস্ত অবস্থায় মরিয়ম কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। সেই সময় উদ্যোক্তার স্বামী শুভ তার দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী কাটারি চিড়া, কাটারি ভোগ চাল, চিনি গুঁড়ার চাল, ও মসলা নিয়ে ফেইসবুক পেজ -এ “কাটারি ও মসলা সম্ভার” নামে একটি পেইজ খুলে অনলাইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৫ দিনে সেই ব্যবসা থেকে প্রায় ৯০ কেজি চাল বিক্রি হয়।

এই কাজে মরিয়ম ও তার স্বামী খুব উৎসাহ পান। এই উৎসাহের সূত্র ধরে মরিয়ম ও তার স্বামী, মরিয়মকে তাঁর হাতের তৈরি উলের পাপোষ নিয়ে অনলাইন ফেইসবুক পেজ -এ “মনি কুটির” নামে একটি পেজ খুলে দেন।

প্রথম এক মাস কোনো সেল হয়নি। পরবর্তীতে বিভিন্ন ফেইসবুক পেজে উদ্যোক্তা তাঁর পণ্যের পোস্ট করা শুরু করলে একটা দুটো করে অর্ডার আসা শুরু হয়। তারপর উদ্যোক্তা তার পণ্যের আইটেম বাড়ানো শুরু করেন। মরিয়ম ও তার স্বামী মিলে নতুন ডিজাইনের ল্যাম্পসেড তৈরী করেন।
গুটি গুটি পায়ে একটা দুইটা অর্ডার আসতে থাকে। প্রডাক্ট আইটেম ও বারতে থাকে। উলের তৈরি পাপোষ ও ল্যাম্পসেড, উলের টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, ওয়ালমেট, ছোট ও বড়দের কুশিকাটার জুতা, সেন্ডেল, সোনামনিদের জামা, জুতা, টুপি, কটি, ছোট-বড় নকশিকাঁথা, নকশি-বেডশীট, নকশি কাপড়ের ওয়ান পিস, টু পিস, থ্রি পিস, হারবাল হেয়ার প্রোটিন ও ওয়েল ব্যবসার নতুন পণ্য সংযোজন হয়।

মরিয়ম বলেন -“আলহামদুলিল্লাহ সবার আগে মহান আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করতে চাই। নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে আল্লাহর অশেষ রহমতে ব্যবসায় ভালো সেল হচ্ছে”।

উদ্যোক্তা জীবনের চ্যালেঞ্জ গুলো জানতে চাইলে তিনি জানান, মেয়ে হয়ে চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তার হওয়া মসৃণ ছিল না। প্রতিটি পদে পদে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করত হয়েছে। সামাজিক বাধা, পর্যাপ্ত অর্থ সংকট, ই-কমার্স নলেজ, মানসম্পন্ন প্রোডাক্ট সোর্সিং, বিদেশি পণ্যের সাথে দেশি পণ্যের প্রতিযোগীতায় টিকে থাকা ইত্যাদি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সামনে আগাতে হয়েছে।

মরিয়ম বলেন- “লড়াইয়ের দক্ষতাকে সম্বল করে স্বপ্ন দেখছি একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার। আল্লাহর রহমত ও সকলের সহায়তাই পারবে আমার স্বপ্নের লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমার ইচ্ছা আছে বিলুপ্ত প্রায় শিল্পকে নতুনভাবে উপস্থাপন করার। আড়ংয়ের মত আমারও একটি প্রতিষ্ঠান হবে। যেখানে দেশের বেকার নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। দেশের মানুষ চিনবে -“মনি কুটির” কে। সকলের সহযোগিতা কামনা করছি সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন”।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here