সমাজের পিছিয়ে থাকা নারী কিংবা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কাজে লাগিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করার চিন্তা একজন উদ্যোক্তার মনেই বেশি আসে। উদ্যোক্তা সবসময় চান নিজের পাশাপাশি সমষ্টিগত উন্নয়ন। সে কারণেই রিমা খাতুন উদ্যোক্তার পাশাপাশি একজন প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। ছোট বড় সবাইকে অনলাইনে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির কাজ করছেন। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানের পথও তৈরি করে দিচ্ছেন।
অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আব্দুল হাকিমের মেয়ে রিমা খাতুন। রাজশাহী কলেজ থেকে অনার্স, মাস্টার্স শেষ করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের ননফরমাল শিক্ষক হিসেবে যুক্ত আছেন। পাশাপাশি অনলাইনে গহনা তৈরির প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। সরকারি ভাবে তিন হাজারের বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আরও প্রায় ১০০ জনকে৷
‘নাগরিক উদ্যোগ’ নামে একটি এনজিওতে শিক্ষকতা করতেন রিমা। সেখানে প্রতি বছর শিশুদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানের জন্য কিছু গার্মেন্টস কর্মীর শিশুদের নাচ শেখান তিনি। তাদের নাচের জন্য এনজিও ম্যানেজমেন্টের কাছে গহনা চাইলে বাজেট কম থাকায় গহনা কেনার টাকা দেয়া হয় না। পরে পরিচিত এক আন্টি যিনি পুতির কাজ করতেন, তার কাছ থেকে পুতি এনে সবার জন্য গহনা বানান রিমা। তারা সেগুলো পরে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। সবাই খুব প্রশংসা করে তার গহনার। শিশুরাও অনেক খুশি হয়। সবার প্রশংসা পেয়ে গহনা তৈরির কাজ শুরু করেন এবং এনজিওতে গার্মেন্টস কর্মীর শিশুদের তা বানানোর কৌশল শেখাতে শুরু করেন। সেই থেকে একজন উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন দেখেন রিমা খাতুন।
২০১৭ সালে মাত্র ১,১০০ টাকা দিয়ে গহনা তৈরির টুলস কিনে গহনা বানানোর কাজ শুরু করেন। যেহেতু এনজিওতে শিশুদের শেখাতেন, তাই অফিস থেকেই ম্যাটেরিয়ালস কিনে দিতো এবং সেগুলো দিয়েই কাজ করতেন। এনজিও থেকে সেমিনার এবং কোনো ট্রেনিংয়ে গেলে সেখানে তার বানানো গহনাগুলো নিয়ে যেতেন এবং সেল করতেন। অনেক শিশুও বানাতো তার সাথে৷ সামাজিক পাতায় একটি পেজ খুলে সেখানে নিয়মিত পোস্ট দিতেন। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য অনলাইনে কিংবা অফলাইনে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণও নেন রিমা খাতুন।
মূলত রিমা সব ধরনের গহনা নিয়ে কাজ করেন। সব ধরনের গহনার কাজও তিনি শেখান। লুমবিডিং গহনা, মেটাল, পুতি, রেজিন, গামছা গহনা, সিড বিডস গহনা, সুতার গহনা, হলুদের গহনা, পুটলি গহনা, এপ্লিক গহনা, ক্লে গহনা এবং কাঠের গহনার কাজ করে থাকেন। বর্তমানে লুমবিডিং নিয়ে কাজ করছেন বেশ। এটি একটি মালা, এটি মূলত আদিবাসীরা বেশি পরেন। জনপ্রিয় মালা পণ্যেটির চাহিদাও অনেক বেশি।
রিমা খাতুন তার উদ্যোগের নাম দিয়েছেন ‘আয়না বিবি’। নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: ‘আয়না বিবি’ নাম দিয়েছি কারণ আয়না মানুষের আসল রূপটা দেখায়, ফেইক কিছু দেখায় না। তেমনই আমি যাদের নিয়ে কাজ করছি তারা প্রত্যেকেই একজন করে আয়না বিবি, কারণ তারা তাদের পরিশ্রম দিয়ে নিজের আসল রূপটা সবাইকে দেখাচ্ছে যা দিয়ে তারা তাদের অর্থসংস্থান করতে পারছে।
নিজস্ব কোনো কারখানা বা ফ্যাক্টরি না থাকলেও অনলাইন ও অফলাইন মিলিয়ে ৮০ জনের বেশি কর্মী আছে তার। সম্প্রতি আমেরিকা থেকে ৯টি গহনার অর্ডার পেয়েছেন তিনি। বান্দরবানে সব চেয়ে বেশি যায় তার পণ্য, এরপর ঢাকা, চট্টগ্রাম, জামালপুর, ময়মনসিংহে। মাসে ১৫ থেকে ২০টা গহনা বানানো হয়। মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার মতো আয় হয় তার।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে উদ্যোক্তা রিমা খাতুন বলেন, “লুমবিডিং বা তাঁতগহনা নিয়ে বাংলাদের অন্য জেলাতেও প্রশিক্ষণ দিতে চাই এবং সেই এলাকার অসহায় আয়না বিবিদের আয়ের পথ করে দেয়ার ইচ্ছা আছে। ঢাকায় ওয়ার্কশপের ব্যবস্থা করবো যেখানে এসে আপুরা লুমবিডিং এর কাজ করতে পারবে, পু্তি-সুতাসহ যা যা লাগবে নিয়ে যাবে।”
তিনি বলেন: আমি জানি একটা মেয়ের জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো কতটা দরকার। যদি আমি দুই হাজারও আয় করি সেটাই আমার শক্তি। টাকা ছাড়া পৃথিবীতে চলা কঠিন। আর উপরে মহান সৃষ্টিকর্তার সহযোগিতায় আমি সেই টাকা আয়ের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। অন্য ট্রেইনারদের মতো শেখানোর পর আর চিনছি না– এমন করিনি। বরং তাদের নিয়েই আমি কাজ করছি। ছুটে চলেছি। আমি অনেক খুশি৷ তারা আমাকে যে পরিমাণ ভালোবাসে তার মুল্য কোটি টাকা দিয়েও পূরণ হবে না। আমার লক্ষ্য হচ্ছে ‘ঘরে বসে আয় করি, সংসারের হাল ধরি’।
সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা