‘সোনালী আঁশ’ নামে পরিচিত বাংলাদেশের পাট পরিবেশবান্ধব এবং বহুমুখি ব্যবহারযোগ্য একটি আঁশ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্য অনেক আঁশের সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। পাটের বস্তা এখনও দেশের একটি গুরুত্বর্পূণ শিল্প। অন্য ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে সুতা, পাকানো সুতা, চট, কার্পেট ব্যাকিং ইত্যাদি। পর্দার কাপড়, কুশন কভার এবং গরম কাপড় তৈরির জন্য উলের সঙ্গে মিশিয়েও পাট ব্যবহার করা হয়। উপজাত হিসেবেও পাটের আঁশের বহুমুখি ব্যবহারের মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, ওষুধ, রং ইত্যাদি। ঘরের বেড়া, ছাউনি এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয় পাটখড়ি। বাঁশ এবং কাঠের বিকল্প হিসেবে পার্টিকেল বোর্ড, কাগজের মণ্ড ও কাগজ তৈরিতেও পাট খড়ি ব্যবহার হয়। সম্প্রতি পাট থেকে জুট পলিমার তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেন ড. মোবারক আহমেদ খান যা “সোনালি ব্যাগ” নামে পরিচিত। পাটের কচি পাতাকে শাক হিসেবেও খাওয়া হয়।
প্রাচীনকাল থেকে প্যাকেজিং-এর কাঁচামাল হিসেবে পাট ব্যবহার হয়ে আসছে। বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার আগে এটি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রশি, হাতে তৈরি কাপড়, শিকা ও গৃহসজ্জার সামগ্রীসহ গৃহস্থালি ও খামারের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হতো। মধ্যযুগে বাংলায় পাটজাত দ্রব্যের মধ্যে গানিবস্তা ও পাটশাড়ির বহুল ব্যবহারের তথ্য পাওয়া যায়। আঠারো শতক থেকে বিদেশে গানিব্যাগ রপ্তানি হয়েছে। শণের বিকল্প হিসেবে পাটের বাণিজ্যিক ব্যবহার আরম্ভ হয় পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষত ডান্ডিতে। পাটজাত দ্রব্যের প্রথাগত ব্যবহার প্রধানত পাকানো সুতা, শক্ত কাপড়, চটের ব্যাগ, টুইল কাপড়, কার্পেট ব্যাকিং, উল-প্যাক, মাদুর, মোটা কাপড়, দেয়াল-আচ্ছাদন, গালিচা ও বিভিন্ন ধরনের গৃহসজ্জার বস্ত্র প্রভৃতিতে সীমাবদ্ধ ছিল।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2022/05/jute-middle-.jpg)
পাটের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯০০ সালে ভারত সরকার তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার জন্য একজন পাট বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করে। এ গবেষক এবং তাঁর সহকর্মীরা পরবর্তীতে কয়েকটি উন্নতজাতের পাট উদ্ভাবন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাকিয়া বোম্বাই (Kakya Bombai), ডি১৫৪ এবং Chinsurah Green। ১৯৩৮ সালে ঢাকায় সর্বপ্রথম একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পাট গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রায় একই সময়ে কলকাতার টালিগঞ্জে একটি প্রযুক্তি গবেষণাগারও স্থাপিত হয়। ১৯৫১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঢাকায় কেন্দ্রীয় পাট কমিটি গঠিত হয় এবং ১৯৫৭ সালে তেজগাঁওয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় একটি পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। বর্তমানে ঢাকার শেরে-বাংলা নগরে মানিক মিঞা এভিনিউ-তে অবস্থিত এই গবেষণাগার বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নামে পরিচিত।
বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলায় পাট উৎপন্ন হলেও ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরই প্রধান পাটচাষ অঞ্চল। সবচেয়ে বেশি পাট হয় ফরিদপুর জেলায়। পাটচাষের মোট জমির পরিমাণ প্রায় ২,২৬,৬৫৫ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৪০,৩৪,৫৮৯ বেল। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ২৭টি উচ্চফলনশীল ও উন্নত মানের পাটের জাত উদ্ভাবন করেছে।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2022/05/jute-middle-2.jpg)
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, মায়ানমার, চীন, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ব্রাজিল এবং অন্যান্য আরও কয়েকটি দেশে পাটের আবাদ হয়। বাণিজ্যিক দিক থেকে বাংলাদেশ এক সময়ে একচেটিয়া সুবিধাপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো এবং ১৯৪৭-৪৮ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাজারে এদেশ থেকে প্রায় ৮০ শতাংশ পাট রপ্তানি হতো। কিন্তু ১৯৭৫-৭৬ সাল নাগাদ এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং বর্তমানে বিশ্ব চাহিদার শতকরা ২৫ ভাগ পাট বাংলাদেশ থেকে যায়। এ অবনতির বড় কারণ পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা এবং সেসঙ্গে বিশ্ববাজারে কৃত্রিম তন্তুর আবির্ভাব।
পাটজাত পণ্য সব সময়ই পরিবেশবান্ধব। ইদানীং চট, বস্তা, পলিথিন ছাড়াও চোখ ধাঁধানো শোপিস, চেয়ার, দরজা, ফুলদানি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, স্যুট-প্যান্ট, চাদর, এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য যেমন সৌন্দর্যবর্ধক তেমনি শতভাগ পরিবেশবান্ধব এবং দামও সাধ্যের মধ্যে। ফলস্বরূপ, এসবের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে বিশ্ববাজারের ক্রেতাদের। ফলে এ শিল্প দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
২০১১ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হাতে যে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাটের ব্যাগ তুলে দেয়া হয়েছিল, সেগুলো গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকেই। আশ্চর্য হলেও সত্য, বর্তমানে নামিদামি গাড়ি তৈরির কোম্পানিও পাট ব্যবহার করছে। জার্মানির বিএমডব্লিউ কোম্পানির সর্বাধুনিক ইলেকট্রিক গাড়ির ভেতরে বক্স বডি ও এর উপাদান তৈরির কাঁচামাল হিসেবে পাট ব্যবহার হচ্ছে। জার্মানির ভক্সওয়াগন, জাপানের নিশান ও টয়োটা গাড়ির কাঁচামাল হিসেবেও বাংলাদেশের পাটের কদর রয়েছে।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2022/05/jute-middle-3.jpg)
সম্প্রতি করোনার ধাক্কা কাটিয়ে দেশের রপ্তানি খাত ঊর্ধ্বমুখী হলেও পাট পণ্যের রপ্তানি বাড়েনি। চলতি অর্থবছরের (২০২১-২০২২) শুরু থেকেই দেশের পাট রপ্তানি খাত গতি হারাতে থাকে। প্রথম সাত মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পাট পণ্যের রপ্তানি কমেছে ৯ শতাংশ। অথচ আগের অর্থবছরে (২০২০-২০২১) পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৩২ শতাংশ।
তবে, গত কয়েক মাসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত সাত মাসে পাট থেকে তৈরি সুতা, বস্তা ও ব্যাগ রপ্তানি কমলেও কাঁচাপাট এবং অন্যান্য পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে।
পাট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সম্প্রতি কাঁচা পাটের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব রপ্তানিতে পড়েছে। তাছাড়া পণ্য পরিবহন খরচও বেড়েছে কয়েকগুণ।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল ৪১ শতাংশ। পরের মাসগুলোতে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় তা ৯ শতাংশে নেমেছে। অর্থবছরের এই সাত মাসে পাট পণ্য থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ৬৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার (প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা), যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার (সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা)।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাটের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। নতুন নতুন উদ্যোক্তারা পাট ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করছে বিশ্ব দরবারে। তাই এর প্রসার এবং প্রচারের লক্ষ্যে আরো দ্রুত বিভিন্ন যুগোপযোগী উদ্যোগের মাধ্যমে পাটের ব্যবহার বহুমুখি করতে হবে। সরকার দেশে ও বিদেশে পাট পণ্যের ব্যবহার বিস্তৃত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2022/05/jute-middle-4.jpg)
পাট উৎপাদন থেকে শুরু করে পাট সংগ্রহ, সংরক্ষণ-এবং যুগোপযোগী পণ্য তৈরিসহ সবকিছুতে আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। তাই পাটের চাষ বৃদ্ধি করতে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধাসহ কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করতে হবে। পাটের ব্যাপক চাষাবাদ, বন্ধ পাটকলগুলো চালু করা, পাটের বহুমুখি ব্যবহার ইত্যাদির ফলে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে। এর ফলে পাটচাষিদের মধ্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা বাড়বে। ফলে উত্তরোত্তর বাড়বে পাট চাষ।
সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা