বগুড়ায় বছরে ৪০০ কোটি টাকার দই এবং ৩০০ কোটি টাকার মিষ্টি কেনাবেচা হয়।ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় বগুড়ার দইয়ের বেশ চাহিদা রয়েছে। এমনকি তা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও যাচ্ছে।
দুধ ও মাটির সরা-হাঁড়িরও বড় ব্যবসা রয়েছে বগুড়ায়। মাটির সরা ও হাঁড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন পাল সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ।
দেশের সব জেলাতেই সব সময় কমবেশি দই তৈরি হয়। কিন্তু গত শতকের শুরু থেকে এখন অবধি অনন্য স্বাদ, মান, জনপ্রিয়তা আর সুখ্যাতিতে বগুড়ার দই-ই সবচেয়ে এগিয়ে।
এশিয়া সুইটসের অন্যতম কর্ণধার নূরুল বাশার বলেন, ‘বিদেশে দই রপ্তানিতে বড় সমস্যা হলো সংরক্ষণে। এ ছাড়া অসাধু কিছু ব্যবসায়ীর কারণে বগুড়ার দইয়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অখ্যাত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে কম দামে মানহীন দই ঢাকায় নিয়ে বেশি মুনাফায় বিক্রি হচ্ছে।
বগুড়া চেম্বারের সভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, বগুড়ার দই শুধু ঐতিহ্য আর গর্বই নয়; বরং ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও এর গুরুত্ব অনেক। যেমন দইয়ের বিপুল বাজারের কারণে এই অঞ্চলে অনেক দুগ্ধখামার গড়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বগুড়ার দই বিদেশে আরো বেশি রপ্তানি করা যাবে।
বগুড়ার বিখ্যাত সেই সরার দই গত ২৫ জুন ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বগুড়া রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) বগুড়ার সরার দইকে জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। এর ফলে বগুড়ার দই বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে এটির মর্যাদা যেমন বাড়বে, তেমনি রপ্তানিতেও সুবিধা মিলবে। জিআই স্বীকৃতি এই পণ্যের মান ও দাম নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে।
কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দেশের জিআই পণ্যের তালিকায় আছে জামদানি, ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আম এবং নাটোরের কাঁচাগোল্লা।
বগুড়া চেম্বারের সহসভাপতি মাফুজুল ইসলাম বলেন, বগুড়া জেলায় প্রতিদিন এক কোটি টাকার বেশি দই বিক্রি হয়। সেই হিসাবে বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার দই কেনাবেচা হয়। মিষ্টি বিক্রি হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার। এ ছাড়া মাটির সরা ও হাঁড়ি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন পাল সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ।
যেভাবে খ্যাতির শিখরে বগুড়ার দই একসময় ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা গ্রামগঞ্জে ঘুরে বগুড়ার দই বিক্রি করতেন। কালের বিবর্তনে ব্যবসার ধরন পাল্টেছে। এখন শহরের সুসজ্জিত শোরুমে দইয়ের পসরা সাজিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। বিয়েশাদি, ঈদ, পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষসহ বিভিন্ন উৎসব ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে বগুড়ার সরার দই বেশ জনপ্রিয়। প্রবাসী বাংলাদেশি ও বিদেশি পর্যটকদের মাধ্যমে বগুড়ার বিভিন্ন স্বাদের দই ভারত, সৌদি আরব, কুয়েত, পাকিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। প্রবাসী ব্যবসায়ীরাও কারিগর নিয়ে বিদেশে বগুড়ার দই বানিয়ে বিক্রি করছেন।
স্থানীয় কবি ও কথাসাহিত্যিক বজলুল করিম বাহার বলেন, বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোষপাড়ার নীলকণ্ঠ ঘোষের হাত ধরে প্রায় দেড় শ বছর আগে ১৮৬০ বা ১৮৭০ সালের দিকে বগুড়ার দইয়ের যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে এখানকার ঘোষ সম্প্রদায়ের লোকেরা টকদই বানিয়ে ছোট ছোট হাঁড়িতে ভরে তা গ্রামগঞ্জে বিক্রি করতেন। গেল শতকের শুরুর দিকে ঘোষপাড়ার শ্রী গৌর গোপাল পাল বগুড়া শহরে দই বিক্রি শুরু করেন। এরপর বগুড়ার নওয়াব আলতাফ আলী চৌধুরীর (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বাবা) পৃষ্ঠপোষকতায় গৌর গোপাল পাল বগুড়া শহরে দই উৎপাদন শুরু করেন। বগুড়া শহরের নওয়াববাড়ি সড়কে এখনো গৌর গোপালের দুই উত্তরসূরি বিমল চন্দ্র পাল ও স্বপন চন্দ্র পাল ‘শ্রী গৌর গোপাল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামে প্রাচীন দোকানটি চালাচ্ছেন।
জনশ্রুতি আছে, দেশভাগের পর একবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী পার্লামেন্টের সদস্যদের দই খাইয়ে বাহবা পেয়েছিলেন। বিদেশে প্রথম বগুড়ার দইয়ের সুখ্যাতি পৌঁছায় ১৯৩৮ সালে। ওই বছরের গোড়ার দিকে তৎকালীন বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়ার নওয়াববাড়িতে বেড়াতে এলে তাঁকে কাচের পাত্রে বিশেষ ধরনের দই খেতে দেওয়া হয়। লোভনীয় স্বাদে মুগ্ধ হয়ে বগুড়ার দই ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। আবার কোনো কোনো প্রবীণ ব্যক্তি জানান, ইংল্যান্ডের রানির জন্যও নাকি বগুড়ার দই নেওয়া হয়েছিল। তবে এ সম্পর্কে লিখিত কিছু পাওয়া যায় না।
সরার দইয়ের জন্য প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান
স্বাদ ও মান বিবেচনায় বগুড়ার প্রসিদ্ধ দই প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এশিয়া সুইটস, দইঘর, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল, শ্যামলী হোটেল, রফাত দইঘর, মহররম আলীর দই, গৌর গোপালের দই, রফাতের দই, চিনিপাতা দই, শেরপুর দইঘর, ফুড ভিলেজ, সাউদিয়া, জলযোগ, বৈকালী ও শুভ দধি ভাণ্ডার, শম্পা দধি ভাণ্ডারের দইয়ের কদর তুলনামূলক বেশি।
গৌর গোপাল দইঘরের মালিক বিমল চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘দাদু গৌর গোপালের হাত ধরেই বগুড়া শহরে দইয়ের বাজারজাত শুরু হয়েছিল। তাঁর স্মৃতি ও সুনাম ধরে রাখতেই গৌর গোপাল দইঘর এখনো দইয়ের আসল স্বাদ ও মান ধরে রেখেছে।’
বিমল ঘোষের ভাই বিপ্লব চন্দ্র বলেন, বর্তমানে নানা পদের দই বাজারজাত হচ্ছে। এর মধ্যে আদি টকদই, চিনিবিহীন সাদা দই, বেশি মিষ্টি সুপার দই, অল্প মিষ্টির স্পেশাল ভুনা দই, শাহি দই, চিনিপাতা দইসহ হরেক পদের দই সরা ও হাঁড়িতে করে বিক্রি হয়।
সুখ্যাতি বাড়ছে দিন দিন
বগুড়ার দইয়ের স্বাদে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য এবং বিপণনে অভিনবত্ব ও আধুনিকতা আনার চেষ্টা হয়েছে সব সময়। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এশিয়া সুইটস। তাদের কারিগরেরা প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের দই তৈরি করে চলেছেন।
তাঁদের চিরাচরিত ঘিয়ে রঙের দইয়ের পাশাপাশি তাঁদের সাদা রঙের ভুনা সরের অল্প মিষ্টির ‘শাহি স্পেশাল দই’, কড়া মিষ্টির ‘সুপার স্পেশাল দই’, মিষ্টিহীন সাদা দই এবং পাতলা টক দই বেশি জনপ্রিয়। এশিয়া সুইটস প্রতি সরা শাহি ও সুপার স্পেশাল দই ২২০, সাদা সরা ১৬০ ও পাতলা টক দই ৮০ টাকায় বিক্রি করে।
এর ফলে বগুড়ার দইয়ের সুখ্যাতি বেড়েছে। জানা গেছে, ভারতে বিচ্ছিন্নভাবে এবং প্রবাসীদের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বগুড়ার দই যাচ্ছে। বগুড়ার কারিগরেরা মধ্যপ্রাচ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বগুড়ার দই উৎপাদন করছেন। বগুড়ার দইকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রাখছে এশিয়া সুইটস। ভারত, নেপালসহ কয়েকটি দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় এশিয়ার দই প্রশংসিত হয়েছে বলে জানা গেছে।
ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা