উদ্যোক্তা আখতারুজ্জামান তুষার

বিখ্যাত গাড়ির ব্র্যান্ড মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ, ফোর্ড পাটের ফাইবার ব্যবহার করে ইন্টেরিয়র কম্পোনেন্ট তৈরি করছে। শোপিস থেকে শুরু করে স্যুট, ব্লেজার, শাড়ি- কী হয় না! পাটপাতার চা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

ছালা ও বস্তার সেই যুগ পেরিয়ে এখন পাট থেকে হচ্ছে দারুণ সব নজরকাড়া পণ্য। বৈচিত্র্যময় বহুমুখী পণ্যই পাটের ভবিষ্যৎ, তাইতো দেশেও সৃষ্টিশীল কিছু উদ্যোক্তারা প্রচলিত পাট পণ্যের ধারণা থেকে বের হয়ে পাটের জন্য পালাবদলের জয়গান করে চলেছেন।

তেমন একজন পাটের ফেব্রিকস নিয়ে কাজ করা তরুণ উদ্যোক্তা আখতারুজ্জামান তুষার। যিনি সাম্প্রতিক সময়ে কাজ করছেন পাটের একটি শপিং ব্যাগ নিয়ে। পরিবেশ বান্ধব এই শপিং ব্যাগ থাকবে গণমানুষের হাতে হাতে।

তুষারের গড়া ‘তাসনিম ইন্টারন্যাশনাল’ এর পাটের ফেব্রিকস রপ্তানি হয় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে। পাট নিয়ে পালাবদলের চিন্তায় মগ্ন থাকা তুষারের হাতে কলমে প্রশিক্ষণে বেশ কয়েকজন তরুণ হয়েছেন সাবলম্বী, নিজেদের গড়ে তুলেছেন পাটের উদ্যোক্তা হিসেবে।

পাটের শপিং ব্যাগ করার ভাবনা কিভাবে এলো জানতে চাইলে উদ্যোক্তা আখতারুজ্জামান তুষার উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ, বেশ কিছু দেশে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের আইন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের পাট সবচেয়ে ভালো পাট। বিশ্বে প্রচুর পাটের ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। তাইতো আমি পাটের এমন একটা সাশ্রয়ী ফেব্রিকস তৈরি করতে যাচ্ছি যাতে মানুষ পলিথিন বাদ দিয়ে পাটের শপিং ব্যাগ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়।

শপিং ব্যাগের সর্বশেষ আপডেট জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনার মধ্যেও কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে বড় অঙ্কের টাকাও খরচ হয়েছে। আমি চাচ্ছি যে পাটের ফেব্রিকসটা দুই শ গ্রামের নীচে নিয়ে আসতে। এখন যেটা আছে সেটা আড়াই শ গ্রাম। ফেব্রিকস যদি দুই শ গ্রামের নীচে করতে পারি তাহলে গ্রাহকের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে দিতে পারব। আমি চাচ্ছি গ্রাহক বিশ থেকে ত্রিশ টাকার মধ্যে শপিং ব্যাগটি কিনুক।

‘‘বর্তমানে শপিং ব্যাগটি নিয়ে বিপণনের পরিকল্পনা করছি, পাশাপাশি টেকনিক্যাল কাজগুলো করছি। ফ্যাক্টরিতে লোকবল নিরলসভাবে কাজ করছে।’’

টাঙ্গাইলের করোটিয়ার গড়াসিনে কারখানা তুষারের। ঢাকায় অফিস মধ্য পাইক পাড়া মিরপুর-১ এ। এছাড়াও পাটের শপিং ব্যাগের জন্য ইতোমধ্যেই গড়েছেন একটি লিমিটেড কোম্পানি। যার অফিস লালমাটিয়ায়।

পাটের ফেব্রিকস নিয়ে কাজ করার পেছনের গল্প জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উদ্যোক্তা বলেন, বিবিএ শেষ করার পর ২০০৮ গার্মেন্টস শিল্পে সহকারী ম্যার্চেন্ডাইজার হিসেবে কাজ শুরু করি। বছরখানেক পর ঢাকার মহাখালীর একটি বায়িং হাউজে যোগদান করি। এরপর খানিকটা অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেই কিছু করার চেষ্টা করি। উত্তরায় অফিস নিয়ে স্টক গার্মেন্টস সামগ্রী ও বিভিন্ন কোম্পানির প্রমোশন্যাল গিফট আইটেম নিয়ে কাজ শুরু করি। মূলত দেশের বেশকিছু বড় বড় প্রতিষ্ঠানে তাদের লোগো যুক্ত পোলো শার্ট, ক্যাপ ইত্যাদি সাপ্লাই করতাম।

‘‘আমার ক্লায়েন্টদের মধ্যে হোলসিম গ্রুপ অন্যতম ছিল। তারা যে কোন প্রমোশন্যাল আইটেমই আমার কাছ থেকে করত। তারা আমাকে কিছু ব্যাগের অর্ডার দেয়, পাশাপাশি ওই সময়ে আমার এক বন্ধু আমাকে কিছু পাটের ব্যাগের স্যাম্পল দেয়। সেগুলো হোলসিমকে দিলে তারা পছন্দ করে এবং পরে তাদের পাটের নেট কাপড় দিয়ে ব্যাগ তৈরি করে দেই। এইভাবেই পাটের সঙ্গে জড়িত হই।’’

‘‘আমি দেখলাম পাট পণ্যের সেক্টর অনেকটাই আলাদা, তাই গার্মেন্টস ব্যবসা বাদ দিয়ে পাটজাত পণ্যের ব্যবসায় জড়ালাম। এছাড়াও ওই সময়ে পাটমন্ত্রী ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী, তিনি নিজেও টাঙ্গাইলের ছিলেন, আমিও টাঙ্গাইলের ছেলে সেজন্য পাট মন্ত্রণালয়ে বেশ কিছু টাঙ্গাইলের মানুষদের কাছ থেকে পাটের ব্যবসা বুঝতে সুবিধা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে বিষয়গুলো বুঝতে পেরেছি। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টারের (জেডিপিসি) থেকেও অনেক সহায়তা পেয়েছি’’, বলেন তুষার।

‘‘২০১২-১৩ সালের দিকে জেডিপিসি থেকে ট্রেনিং করি, সেসময় বেশ কিছু উদ্যোক্তাদের সাথেও পরিচিত হই। সেখানে দেখি সবাই শুধু পাটের ব্যাগ বানায়, জেডিপিসির কিছু পাটের কাপড় দিয়ে এক রকমের সবাই ব্যাগ বানায়। আমি চিন্তা করলাম ব্যাগ না বানিয়ে কি করা যায়? এরপরই আমি ফেব্রিকস ও হ্যান্ডলুম নিয়ে কাজ শুরু করলাম।’’

পাটের ফেব্রিকসের ক্রেতা কারা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমার ক্রেতা কিন্তু উদ্যোক্তারাই; তারাই আমার কাছ থেকে পাটের ফেব্রিকস কিনে নেয়। যারা পাটজাত পণ্য নিয়ে কাজ করে তারাই এগুলো কিনে নেয়। মূলত বিভিন্ন মেলায় আমি উদ্যোক্তাদের কাছে এই ফেব্রিকসগুলো বিক্রি করি। আমার অধিকাংশ ফেব্রিকস বাইরে রপ্তানি হয়। বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাও (এনজিও) আমার কাছ থেকে সেগুলো কিনে নেয়।’’

আপনার ফেব্রিকস বিশ্বের কোন কোন দেশে যায় জানতে চাইলে আখতারুজ্জামান তুষার বলেন, ‘‘আমার পণ্যগুলো তুরস্ক, ইতালি, ইংল্যান্ডে যায়। চীনে বড় পরিসরে পাটের সুতা আমরা রপ্তানি করি। বাংলাদেশ পাট রপ্তানিতে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে। আমরা বেশি রপ্তানি করি। ভারত কিন্তু এতো পাট রপ্তানি করে না, তারা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নিজেরা প্রসেসিং করে থাকে।”

করোনাকালীন সময়টা কিভাবে পার করছেন, কেমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উদ্যোক্তা বলেন, আমার ফ্যাক্টরিতে এখন একটা পাওয়ার লুম বসানোর চিন্তা করছি। যার মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়া আরো গতিশীল হবে। তবে করোনার জন্য এখনো করতে পারিনি। গত ছয় মাসের করোনার জন্য খানিকটা বিপদেই পড়েছে উদ্যোক্তারা। ফেব্রিকসের ব্যবসা করায় আমার সঙ্গে কম বেশি সকল পাট পণ্য উদ্যোক্তাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। যারা বিভিন্ন মেলা নির্ভর কিংবা লোকাল বাজার নির্ভর তারা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত। আমি মার্চে জাতীয় পাট দিবসের মেলায় বেশ কিছু মোড়কের অর্ডার পেয়েছিলাম, কিন্তু করোনার জন্য সেগুলো বাতিল হয়ে যায়।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি মোকাবেলায় গত ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় মোট ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন।

এরমধ্যে সবচেয়ে বড় প্যাকেজ ছিল ৩০ হাজার কোটি টাকার, শিল্প ও সেবা খাতের জন্য। ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) জন্য। পরে শিল্প ও সেবাখাতের প্যাকেজের অঙ্ক ৩ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়।

এই দুই প্যাকেজের অর্থের অর্ধেক অর্থাৎ ১৫ হাজার এবং ১০ হাজার মোট ২৫ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জোগান দেওয়া হচ্ছে।

দুই প্যাকেজেরই ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিশোধ করবে ঋণ গ্রহিতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

পাট জাত পণ্যের উদ্যোক্তাদের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় কি জানতে চাইলে তুষার বলেন, করোনার মধ্যেও পাট পণ্য থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০ দশমিক ৭০ কোটি ডলার আয় করেছে সরকার। আমরা যে অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে রয়েছি তার থেকে যেন আমরা স্বাভাবিক হতে পারি, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি চাই। ছোট উদ্যোক্তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে না, যা বড় বড় উদ্যোক্তারা পারে।

তুষার বলেন, পাটের উদ্যোক্তাদের বিপণনের জায়গা নেই বা তারা জানে না। এই বিষয়েও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। পাটের ক্রেতা শ্রেণী আলাদা তাই প্রত্যেকটা জেলা শহরগুলোতে যদি সরকারীভাবে পাট পণ্যের ওপর ডিসপ্লে সেন্টার থাকতো সেখান থেকে উদ্যোক্তাসহ ক্রেতারাও লাভবান হতো।

একজন পাট ফেব্রিকসের উদ্যোক্তা হিসেবে সরকারের কাছে চাওয়া জানতে চাইলে আখতারুজ্জামান তুষার বলেন, পাটের নতুন উদ্যোক্তারা সঠিক কোন প্রশিক্ষণ পায় না। সে জন্য তারা সামনে এগিয়ে যেতে পারছে না। যারা বিষয়গুলো জানে তারা হয় বলতে চায় না, অথবা তাদের সময় নেই। একটা নিদিষ্ট সময়কালীন ট্রেনিং চালু হওয়া দরকার, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দ্বারা। আসলে একজন উদ্যোক্তা চান সঠিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তারা সঠিকভাবে ব্যবসা করতে পারে।

পাটের বহুমুখী ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এদিকে নজর দিলে বাংলাদেশও বড় অঙ্কের অর্থ আয় করতে পারবে। কারণ, পাট উৎপাদনে তৃতীয় হলেও বিশ্বমানের পাট এখনও এ দেশেই উৎপাদিত হয়।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here