গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে কিছুদিন ট্রেইনার এর জব করলেন এক তরুণী। মার্কেটিং এবং ট্রেনিং দুটোই একসাথে শিক্ষণ, সব মিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা। যে সংস্থায় কাজ করছিলেন তরুণী সেই সংস্থাটি বন্ধ হয়ে গেলো দুম করে। ভীষণ মুষড়ে পড়লেন তরুণী। কি করবেন জীবনে ভাবতে থাকলেন।
”হতাশ হয়ে এভাবে বসে থাকলে আমি ধীরে ধীরে মানসিক সব সাহস হারিয়ে ফেলবো”- ভাবলেন তরুণী, “এটা হতে দেয়া যাবেনা’’ যেমন করে হোক আমাকে উঠে দাড়াতে হবেই, আমার চাকরি গেছে তো কি হয়েছে? নিজের মনকে কঠিন হয়ে বোঝালেন।
“আমি ব্যবসা করবো যতটুকু শিখেছি বা শেখা হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করেই আমি ব্যবসায় নামবো’’। একবুক সাহস নিয়ে নেমে পড়লেন কাজে, তরুণ মৌসুমী আক্তার ঝর্ণা। আপন ভাই বাহরাইন প্রবাসী জনাব মনির হসেন, ছোট্টবেলা থেকেই বন্ধুর মত বেড়ে ওঠা একসাথে। ভাইকে বন্ধুর মতই বললেন ঝর্ণা- “ভাই আমাকে কিছু টাকা দিবি? আমি ব্যবসা করবো”।
আদরের বোন ব্যবসা করবে। ভাই বললেন “তুই ব্যবসা করবি এটাই বড় কথা, আর কিছু জানার নেই”। পাঠিয়ে দিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা। আর নিজে বন্ধুদের কাছ থেকে ঝর্ণা সেদিন ধার করে নিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা।
১ লক্ষ টাকা দিয়ে সেদিন একটা শো রুম নেওয়া হল। এডভান্স, ডেকোরেশন এবং পণ্য সব কিছু এই ১ লক্ষ টাকা দিয়েই সেদিন সেরেছিলেন উদ্যোক্তা মৌসুমী আক্তার ঝর্ণা।
২০১৩ সাল, পণ্য হিসেবে থ্রি পিস এবং লেডিস ওয়্যার নিয়ে ব্যবসায় নামার ৬ মাসের মাথায় ঝর্ণা বুঝে ফেললেন “না শিখে ব্যবসা নয়“। ব্যবসা বন্ধ করে দিলেন। শিক্ষণ তো হলো। লস তো হয়নি, সমান সমান।
শুরু হল ট্রেনিং নেয়া। এসএমই ফাউন্ডেশন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, নারী কল্যান সংস্থা, রংধনু একাডেমী এমন প্রায় ২০ টি নামকরা সংস্থা থেকে ২০ টির ওপর ট্রেনিং নিলেন ঝর্ণা টানা ২ বছর। ২০১৪-১৫ সাল পাগলের মত ট্রেনিং করাটাই যেন নেশা হয়ে গেলো ঝর্ণার, আমাকে শিখতেই হবে, আমি শিখব, আমি পারব।
ট্রেনিং নেয়া হয়েছে বিস্তর। ২০১৫ সালে আচার এর ব্যবসা করবার সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করলেন নতুন ঝর্ণা। এই ঝর্ণা যেন অনেক বেশী কনফিডেন্ট, কারণ ট্রেনিং তাকে অজান্তেই অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী এবং কনফিডেন্ট করে তুলেছে।
অনলাইনে আচার এর একটি ব্যবসাতে শুরুতেই লাভের মুখ দেখে ফেললেন উদ্যোক্তা, সব সময়ই খাবারের ব্যবসাই যেন বেশি টেনেছিলো ঝর্ণাকে। এটা ঝর্ণা বুঝতে পারলেন আচারের ব্যবসা করতে শুরু করবার পর। ২০১৬ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তরুণ উদ্যোক্তা মৌসুমী আক্তার ঝর্ণা জনাব আরিফুল হক সহেল এর সাথে। জনাব সোহেল বিদেশে চাকরি করেন। বিয়ের পর স্বামী আরিফুল হক সোহেল ভীষণ উৎসাহ দিলেন স্ত্রীর উদ্যোক্তা হবার পথে এগিয়ে যেতে। বিভিন্ন রকম আচার হ্যান্ডমেড এবং সেটা এফ কমার্সে সেল হয় প্রচুর। ঝর্ণা উদ্যোক্তা হবার পথে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেন এবং ভীষণ আগ্রহ ভরা মন নিয়ে নিজের উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে থাকেন। ২০১৯ সালে যুব মেলায় অংশ নিলেন তরুণ উদ্যোক্তা। ভীষণ সাড়া মিললো মেলার পুরো সময়টি এবং উদ্যোক্তা হতে থাকেন উৎসাহী।
২০২০ সালে এসএমই ফাউন্ডেশন আয়োজিত জাতীয় এসএমই মেলায় একটি স্টল নেবার জন্য নিজের গলার চেন বিক্রি করে দিলেন উদ্যোক্তা ঝর্ণা। জাতীয় পর্যায়ে সবচাইতে বৃহৎ এসএমই মেলায় নিজেকে প্রমাণ করবই আমি।
এতটা সাড়া মিলবে ঝর্ণা কল্পনাও করেননি। নিজের কল্পনাকে হার মানিয়ে মাত্র ৪ দিনেই ৫০ হাজার টাকা উঠে আসে উদ্যোক্তার। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে যেন নিজের দেখা আয়নায় চিনতে কষ্ট হচ্ছিলো। “আমি পেরেছি, আমার ক্রেতারা আমার নিজের ফ্যাক্টরীর তৈরি পণ্য খেয়ে ভীষণ সন্তুষ্ট এ চিন্তাটা ঝর্ণাকে যতটা তৃপ্তি দিচ্ছিলো ঠিক ততটাই মনের ভেতর শঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হতে থাকল কারণ বিশ্বব্যাপী আঘাত হেনে বসেছে এক কঠিন মহামারী কভিড-১৯-২০ সালে ঝর্ণার ঝর্ণাধারার মত দেখতে পাওয়া সফলতাতে সারা বিশ্বের আর সবার ব্যবসার মতই এক কঠিন আঘাত করে পুরো স্তব্ধ করে দিল এক অতিমারী।
লক ডাউনে পুরো ২ মাস ঘরে বসে থাকা। ব্যবসা পুরো মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু যিনি একজন উদ্যোক্তা তিনি তো জীবনের যুদ্ধ সাগরে শক্ত বৈঠা নিয়ে তরী পাড় করতে সব সময় থাকেন তৈরি। একজন উদ্যোক্তার সজাগ দৃষ্টি তার পথকে খুঁজে নিতে খুব বেশি সময় নিতে দেয়না, সময় তো বহমান এর মধ্যে উদ্যোগ এর চিন্তা এবং পথ তো যোদ্ধা উদ্যোক্তাকেই বের করতে হবে।
লক ডাউনের পুরো সময়টি উদ্যোক্তা হিসেবে টিকে থাকবার সকল যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন।
২০১৯ সালে ভারত বেড়াতে গিয়েছিলেন ঝর্ণা। কোলকাতা নিউমার্কেটে মসলা চা খাওয়ার সময় নিজের আগ্রহ থেকেই চা তৈরির রেসিপি লিখে নিয়ে এসেছিলেন। নিজের ডায়রি ঘেটে সেই মসলা চা’এর রেসিপি খুঁজে বের করলেন ঝর্ণা। এতটাই শিহরিত ছিলেন ঝর্ণা এবং এতটাই আনন্দিত ছিলেন একারণেই যে, সৃষ্টিকর্তা তার জন্যই বোধহয় সেই চিন্তাটা তার মাথায় সারা বিশ্ব যখন থেমে আছে সেই সময়টিতেই দিয়েছিলেন।
জীবনের শেখা কিছুই যায়না বিফলে– ঝর্ণা আবার কোমর বেধে শুরু করলেন। নিজে বিভিন্ন সময়ে চা রেসিপি ধরে চা বানানো এবং পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের তৈরি করে খাওয়াতে থাকলেন ঝর্ণা। স্বাদ এবং গুনাগুণ নিয়ে সবার মতামত এতটাই পজিটিভ ইম্প্রেশন এনে দিলো ঝর্ণার মনে যে, ঝর্ণা ঘরে সবাই যখন বন্দি সে সময় যেন নতুন আলোর সন্ধান পান। মনের মেঘ যায় কেটে। অনেক হতাশা দুশ্চিন্তার মাঝেও ঝলমলে আলো উকি দিয়ে যায় আধারের মেঘ ফেড়ে।
সবাই লক ডাউনের সময় যখন গরম পানি এবং এবং গ্রীন টি, মসলা টি এগুলো প্রাকৃতিক পানীয়র প্রতি ঝুকছিলো সে সময়টিই ঝর্ণার নতুন স্বাস্থ্যকর পানীয় চা এর উদ্যোগ নেবার সময় হয়ে দাঁড়াল।
৫০০০ টাকা দিয়ে ২০২০ সালের জুন মাসে বাণিজ্যিক উৎপাদনে নেমে গেলেন ঝর্ণা। প্রথম ২০০০ প্যাকেট মসলা চা উৎপাদন করলেন ঝর্ণা। প্রথম লট উৎপাদনের সময়টির কথা বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার চোখ মুছলেন ঝর্ণা, কেঁদে ফেললেন। এই সময়টিতে নিজের খাবারের, মাসিক বাজারের টাকাটিও তার পণ্যের প্রথম উৎপাদনে ব্যয় করেছেন ঝর্ণা কঠিন আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ মনোবল নিয়ে।
এর পরের ব্যাপারটি অনেকের জন্য হয়তো শুরু করবার একটি উদাহরণ হবে। অনলাইনে মাত্র ২ মাসের মধ্যে ২০০০ প্যাকেট চা বিক্রি করে ফেললেন ঝর্ণা, সাথে মিলতে থাকে নিজের মসলা চায়ের প্রশংসা, সাধুবাদ উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা ক্রেতাদের বন্ধুদের কাছ থেকে।
মিলে বিএসটিআই এর অনুমোদন।
সাথে সাথে প্রথম পাইকারী অর্ডার আসলো রাঙ্গামাটি থেকে। স্বামী জনাব আরিফ এবার পুরো ঘটনা জানলেন। কষ্ট করে লক ডাউনের মধ্যে নিজের খাবারের টাকা, মাসিক বাজারের টাকা দিয়ে পণ্য উৎপাদন করেছেন ঝর্ণা, আলু ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে খেয়ে একজন উদ্যোক্তার তৃপ্তি নিয়ে হাসিমুখে স্বামীকে সান্তনা দিয়ে বলেছেন “মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছি”। এক ফোঁটাও বুঝতে দেননি একজন উদ্যোক্তার যুদ্ধ কি!
স্বামী সব শুনে কেঁদে দিলেন। অনেক সাহস দিলেন। কংগ্রাচুলেট করলেন, সাথে সাথে খুশি হয়ে সহ উদ্যোক্তার মত দেড় লক্ষ টাকা দিলেন প্রত্যয়ী উদ্যোক্তা মৌসুমী আক্তার ঝর্ণাকে।
মেশিন কিনে ২ জন কর্মী সদস্যকে সাথে নিলেন এবার উদ্যোক্তা।
মৌ ফুড প্রোডাক্টস, লক ডাউন ওপেন হতে হতেই পুরো ব্যবসাকে গুছিয়ে ফেললেন ঝর্ণা। পাইকারদের ফোন আসে- “আপনার শুধু একটাই চা?” কথাটি কিংবা প্রশ্নটি মনে আঘাত করে মসলা চা’র উদ্যোক্তাকে।
এবার উদ্যোক্তা ফোকাস টার্গেট করেন, বাজারে নেই কিন্তু অনেক ডিমান্ড আছে এমন ফ্লেভার এর চা উৎপাদনে যেতে হবে তাকে এবার।
বিস্তর গবেষণা এবং পাড়াশোনা, ৬ মাস গবেষণার ফসল এলো প্রোডাকশন হয়ে। ‘সজিনা চা’ বা সারা সভ্যতা যাকে ডাকে মরিঙ্গা টি। স্বামী আরিফুল হক গবেষণার কাজে সহায়তা করলেন অনেক। আরব দেশে অনেক ধরনের মরিঙ্গা ফ্লেভার টি আছে সেগুলোর প্যাকেট ইনগ্রেডিয়েন্টস রিসার্চ করে শেয়ার করে প্রতিদিন আপডেট দিয়েছেন ভিডিও কলে। টেস্ট করে জানিয়েছেন সেগুলোর স্বাদ গুণাগুন সব কিছু অনেককে নিয়ে।
অক্টোবর ২০২০ এ প্রথম বানিজ্যিক উৎপাদনে যায় মৌ ফুড প্রোডাক্ট মৌ সজিনা চা এর প্যাক ডিজাইন সম্পন্ন করে। ডিসেম্বর এ বাজারে সিজিনা চা ছাড়লেন সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা মৌসুমী আকতার ঝর্ণা।
১ম লট উৎপাদনে ১ম দিনেই ২০ প্যাকেট পরের দিন ১৮ প্যাকেট সজিনা চা বিক্রি হয়ে গেলো। যারা সজিনা চা এর স্বাস্থ্যকর গুণাগুণ সম্পর্কে জানেন তারা ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অর্ডার করলেন, মিলতে থাকে ব্যাপক সাড়া।
সতেজ হয়ে ওঠার ডাক প্রকৃতির আসল ছোঁয়ায়। ঝর্ণার আনন্দ অশ্রু বয়ে যায় ৫০০ প্যাকেট এর অর্ডার যখন ডেলিভারী হয়, ১০০০ প্যাকেট এর বাল্ক অর্ডার আজ যখন কুরিয়ারে তুলে দেন দেশের কোনো অঞ্চলের অর্ডার।
উদ্যোক্তা বার্তার সাক্ষাৎকারের সময় ঝর্ণা উচ্ছসিত আর আশা জাগানিয়া কন্ঠে বললেন “আমি সকল গ্রাহকের সঙ্গে থাকতে চাই সারাদিন”। সকালে আমার উৎপাদিত সজিনা চা এর মাত্র ১ কাপ যোগাবে আমার ক্রেতাদের সারাদিনের শক্তি। অলস ক্লান্তিময় দুপুর অফিস কিংবা বাড়িতে রাঙিয়ে দিবে আমার মসলা টি তার স্বাদে, দূর করে দেবে ঠান্ডা কাশি গলাব্যাথা। আর সন্ধ্যায় সুস্বাস্থ্যে ভরপুর আমার জিরা চা রাখবে আমার ক্রেতাদের বদহজম, পেটের সমস্যা, গ্যাসের সমস্যা সব কিছু থেকে একদম মুক্ত। আমি আমাদের দেশের মানুষের খাবারের একটি সেবা দিয়ে গুণগত মানের পণ্য দিয়ে সফল উদ্যোক্তা হতে চাই। স্বপ্ন দেখি এগিয়ে যাবার নিজের উদ্যোগে”।
৪ জন কর্মী নিয়ে হ্যান্ডমেড টি প্রোডাকশন করে শক্তিশালী স্বপ্ন দেখে বাস্তবে কর্মযোগে এগিয়ে চলেছেন নারী উদ্যোক্তা মৌসুমী আক্তার ঝর্ণা। সামনে দেশের ক্রেতাদের জন্য শ্যাসে থেকে টি ব্যাগে তার প্রোডাকশন নিয়ে আরো নিবিড়ভাবে অংশ হতে চান কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের। হতে চান জীবন যুদ্ধ জয়ে, উৎপাদনে, সক্ষমতায় ও সফলতায় একজন উদ্যোক্তা।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা