সুমনা রহমান শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে হয়ে উঠেছেন সফল। তবে, এই পথ মোটেও মসৃণ ছিলো না। সকল বাধা দূর করে আজ তিনি আত্মনির্ভরশীল।
২০০৯ সেশনে ভর্তি হোন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। ২০১৩ সালে স্নাতক বিএসএস সম্মান কৃতিত্ত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে যখন স্নাতকোত্তরেরজন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক সেই সময়ই জানতে পারলেন তিনি ‘মায়েস্থেনিয়া গ্রাভিস’ নামের মারাত্মক এক দূরারোগ্য নিউরোলজিক্যাল ব্যাধিতে আক্রান্ত যা ধীরে ধীরে তার শরীর কে প্রচণ্ড রকম দূর্বল করতে থাকে। শুরু হয় জীবনযুদ্ধের আরেক নতুন অধ্যায়। এই অসুস্থতাকে সঙ্গী করেই একদিকে ডাক্তারের নিয়মিত ফলো আপ। আবার, স্নাতকোত্তরের প্রস্তুতি আবার ৩৪ তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, এইসব মিলিয়ে নিজের মনকে শক্ত করে শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা আর দুর্বলতা নেয়ার পরও তিনি যখন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ঠিক তখনই ডাক্তার জানালেন যতটা সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে তাকে অপারেশন করাতে হবে এবং সেই অপারেশনের সাক্সেস রেট বাংলাদেশে খুবই কম। তার স্বপ্নের পৃথিবীটা যেন এক মুহূর্তেই থমকে গেল।
স্নাতকোত্তর পরীক্ষাটা দিয়েই ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক এক মাসের মধ্যে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালে ভর্তি হোন এবং তার খুব বড় ধরনের অপারেশন করা হয়। অপারেশনের পর সেই ২০১৪ সাল থেকে আজ পযর্ন্ত দীর্ঘ ০৭ বছর যাবত সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের ডাক্তারদের পরামর্শে আজ অবধি চলছেন, তবে ডাক্তারের মতে এই অসুখটি ইনকিওরেবল ডিজিজ । এর মধ্যে অনেক চাকরির সুযোগ, বিসিএস সহ সকল সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন। তাই সকল চাকরি এমনকি বৃত্তি নিয়ে বিদেশের পরাশোনার সুযোগ কে বাদ দিয়ে তিনি যখন মারাত্মক রকম মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত ঠিক তখনই তার মানসিক সুস্থতার জন্য বাসায় থেকে কি করতে পারি সেটা নিয়ে ভাবতে থাকি। বুঝতে পারলেন কোন রকমের পরিশ্রমের কাজ তার এই অসুখ নিয়ে করা সম্ভব না। তাই ঠিক করলেন অবসরকালীন সময়ে তিনি হাতের কাজ বা হ্যান্ড এ্যাম্ব্রয়ডারি করবেন কেননা এই কাজটির প্রতি ছোটবেলা থেকেই খুব আগ্রহ ছিল। তবে এই হ্যান্ড এম্ব্রয়ডারির মিডিয়ামটি কোন পোশাক বা অন্য কিছু না হয়ে যদি হয় গহনা সেটি একটু ডিফরেন্ট হবে বলে মনে হল, আর তাই সেই থেকেই শুরু করলেন।
কিছুদিন পর হঠাৎ করেই ফেসবুকে পার্বণ নামে তার ব্রান্ডের একটা পেজ খুলে কিছু হাতে বানানো পণ্য পোষ্ট দেন। খুবই অল্প দিনের মধ্যেই তার পণ্য গুলো বিক্রি হয়ে গেল এবং নতুন নতুন অর্ডার আসতে শুরু করল। এভাবে প্রথম মাসেই ২৫ হাজার টাকার পন্য বিক্রি করেন। সেই থেকে আজ পযর্ন্ত নিত্য নতুন পণ্যসম্ভারে পার্বণ এখন জনপ্রিয় একটি ব্রান্ডে পরিনত হয়েছে যুক্ত হয়েছে রিয়েল পার্লের হাতে তৈরি গহনা যা তার পার্বণকে তার গ্রাহকদের আস্থার সাথে চাহিদা পূরণের মাধ্যমে আরো কয়েক ধাপ সামনে এগিয়েছে। বর্তমানে পার্বণের তৈরী পণ্য নেয়ার জন্য দেশের বাইরে থেকেও অর্ডার আসছে যা উদ্যোক্তা কে আরেকটি নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কাজ করতে করতে পার্বণ আজ প্রতিষ্ঠিত একটা মানসম্পন্ন ব্রান্ডে পরিনত হয়েছে।
শারীরিক অসুস্থতার কারনে অনেক সময় পর্যাপ্ত সময় দেয়া সম্ভবপর না হলেও ইচ্ছে আছে পার্বণকে নিয়ে আরো বড় পরিসরে কিছু করার যাতে একদিন তার পার্বণ হতে পারে দুস্থ কর্মহীন নারীদের কর্মসংস্থানের একটি নিরাপদ আশ্রয়। তার পন্য ফর্মালি রপ্তানি হচ্ছেনা এই মুহূর্তে কিন্তু বিশ্বের কয়েকটি দেশে ইনফর্মালি পণ্য পাঠাচ্ছেন। এর মধ্যে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফিলিপাইনে আমার পণ্য পাঠিয়েছি যেটি পার্বণের পণ্য বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। দেশের মধ্যে প্রায় ২০-২৫ টি জেলায় তার পন্য এই মুহুর্তে যাচ্ছে। কিন্তু আশার জায়গা হচ্ছে প্রতিদিনই নতুন নতুন জায়গা থেকে অর্ডার পাচ্ছেন যা উদ্যোক্তাকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে। ফিক্সড কোন সংখ্যা কে ভিত্তি ধরে পণ্য উৎপাদন করেন না তবে যতগুলো অর্ডার পান, সেই পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করে সরবরাহ করছেন এবং অর্ডারের বাইরেও নিত্য নতুন ডিজাইন করছেন প্রতি মাসে ।
মাত্র চার হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে পার্বণের যাত্রা শুরু। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে পার্বণ কে মানুষের একমাত্র আস্থা এবং বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে চান। পার্বণকে নারীদের জন্য একটি নিরাপদ কর্মস্থল হিসাবে গড়ে তুলতে চাই যেটা চেইন শপ হিসাবে পরিচালিত হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ হলো শর্ট কাট পথ পরিহার করতে হবে। দ্রুত লাভবান হওয়ার নেশা পরিহার করে ধৈর্যের সাথে এবং অবশ্যই অধ্যাবসায়ী হয়ে পর্যায়ক্রমে ব্যাবসাকে এগিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা থাকতে হবে। ক্রেতার প্রতি সম্মান রাখা এবং তার অর্থ খরচের মধ্যেও যেন একটা তৃপ্তি থাকে সেই ব্যাপারটা খেয়াল রাখা অনেক জরুরী। পজিটিভ চিন্তা মনে ধারণ করে পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে ধৈর্য্য ধরে এগোতে হবে তাহলে সফলতা একদিন এসে ধরা দিবেই।
মাসুমা সুমি,
উদ্যোক্তা বার্তা