উদ্যোক্তা তাসলিমা ফেরদৌস

অতঃপর স্বামীর কর্মস্থল পুলিশ কোয়ার্টারে বসবাস শুরু করলেন সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা তাসলিমা ফেরদৌস। পড়াশোনার প্রতি অদম্য ইচ্ছায় ভর্তি হলেন ডিগ্রীতে। স্বামী পুলিশের কর্মকর্তা হওয়ায় বাসায় সরকারি টেলিফোনে সহপাঠীরা পরীক্ষার দিনক্ষণ আর সময় জানিয়ে দিতেন।

একসময় স্বামীর সহকর্মীদের স্ত্রীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করলেন। অর্ডার নিয়ে সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং তাদের বাচ্চাদের পড়াতেন। পাশাপাশি ৫০ জন শিশু নিয়ে একটি শিশু শিক্ষালয় গড়ে তোলেন।

সংগ্রামী এক নারী

১৯৯৩ সাল পর্যন্ত সেই স্কুলের দায়িত্বে ছিলেন সংগ্রামী নারী উদ্যোক্তা, পাশাপাশি নারী কর্মীদের নিয়ে সূচী শিল্পের কার্যক্রমও অব্যাহত রাখলেন। সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে HELP- Human Essential Learning for progress নামের একটি সংগঠন গড়ে তুললেন।

স্বামীর বদলির কারনে সেসময় নিজের প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হস্তান্তর করে চলে আসেন বগুড়ায়। আবারো নতুন করে সেলাই কর্মী তৈরীর সিদ্ধান্ত নিলেন। কলেজ ছাত্রী এবং গৃহিনীদের নিয়ে ২০০ কর্মী তৈরী করে কুটির শিল্প ও সূচী শিল্পের পণ্য বিক্রেতাদের কাছে ব্যাপক আকারে সরবরাহ করতে শুরু করেন। নিজেই পোশাক ডিজাইন করতেন। পাশাপাশি সরবরাহ ও কাজের মানের অগ্রগতি নীরিক্ষায় ব্যস্ত থাকতেন। বিভিন্ন মেলাতেও অংশগ্রহন করেছেন।

সারাক্ষন নিজ কাজে মগ্ন তাসলিমা ফেরদৌস

বগুড়ায় একমাত্র সরকারী কম্পিউটার প্রশিক্ষণকেন্দ্র নট্রামস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একসময় নিজেই কিনে ফেললেন কম্পিউটার। কিন্তু সেসময় আবারো স্বামীর বদলির কারনে চলে যান রাজশাহীতে।

রাজশাহীতে গিয়ে নারী ও শিশুদের জন্য ‘কম্পিউটার কর্ণার’ নামে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং একই সাথে হাতের কাজ করা পোশাকের শোরুম দেন সংগ্রামী উদ্যোক্তা। বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে ছেলেমেয়েদের লিফলেট বিলিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসবার জন্য আহবান করেছেন। বলেছেন, “অনেক অল্প পয়সায় শেখাবো, তবুও এসো”। সেসময় ট্রেইনার ছিলেন নিজেই। সাথে সাহায্য করতো একমাত্র ছেলে এবং মেয়ে।

একসময় নিজের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য আবারো পরিবর্তন করতে হলো বসবাসস্থল। কর্মব্যস্ততা ভুলে আসতে হলো ঢাকায়। রাজধানীর জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনা, বাসাভাড়া, খাওয়া খরচের অর্থ যোগান দিতেই যেন নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।

উদ্যোক্তা তার ছেলের সাথে

কাজের সন্ধান শুরু করলেন আবারো। কিন্তু রাজধানীতে মোটা অংকের মূলধন ছাড়া নিজের উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা করাটা যে সহজ নয়। যেহেতু অনেক কষ্টের মাঝেও পড়াশোনা করেছিলেন, সেহেতু একজন গ্রাজুয়েট হয়ে বসে থাকাটা বেমানান।

নিজ যোগ্যতাবলে সমবায় ব্যাংকে চাকুরী হলো। কাজের মূল্যায়নে খুব দ্রুতই প্রোমোশন পেলেন অফিসার হিসেবে। প্রয়োজন ছিলো চাকুরীর তাই চাকুরী করা, কিন্তু মনের মাঝে যে উদ্যোক্তা হয়ে মানবতার তরে কাজ করার স্বপ্ন। সারাজীবন একটা কথাই মেনেছেন, “স্বাধীনতা চাই, সেবা দিতে চাই, চাই মানবকল্যানে কাজ করতে”। কিন্তু চাইলেই তো পারা যায়না। কেটে গেলো আরো ৩ বছর।

২০০৫ সালে মনের সুপ্ত বাসনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ‘বেলাশেষে’ নামের একটি প্রবীন নিবাস কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করলেন সংগ্রামী উদ্যোক্তা।

সেসময় ‘বেলাশেষে’ ছিল আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয়েও যারা সামাজিকভাবে অসহায় তাঁদের জন্য। কিন্তু যাদের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিল না তাঁদেরকেও ফ্রি তে সেবা দেওয়ার সুব্যবস্থাও ছিলো “বেলাশেষে” তে। শুরু হলো মানবকল্যানে নিজের মতো করে কাজ করা। এক দুই করতে করতে ২০ জন প্রবীন মায়ের সেবা দিয়ে শুরু হলো মানবতার কাজের নতুন অধ্যায়।

প্রকৃতির সাথে মিশে থাকেন তাসলিমা ফেরদৌস

একসময় চাকুরী ছেড়ে দিয়ে নিজ উদ্যোগে সমমনা ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সমবায় সমিতি গঠন করলেন। আর্থিক স্বচ্ছলতার পাশাপাশি মানবতার সেবাকে প্রাধান্য দেওয়াটাই ছিলো সমিতির মূল উদ্দেশ্য।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন প্রশিক্ষণে। বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, রেডিসনে আয়োজিত ১৭ দেশের উদ্যোক্তাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার, উইমেন্স চেম্বার অব কমার্সের প্রশিক্ষণ, কম্পিউটার বিষয়ক কর্মশালা, নট্রামসে হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে “আমরা চাকুরী করবো না, চাকুরী দেবো” শীর্ষক কর্মশালা, ওপেন এর প্রশিক্ষন সাভারের ‘হোপ’ ফাউন্ডেশনে উদ্যোক্তাদের ব্যবসা উন্নয়নভিত্তিক পাঁচ দিনব্যাপী সেমিনার। সেই সাথে চালিয়েছেন ‘বেলাশেষে’র কার্যক্রম।

সেই কিশোরীর জীবনের গল্প কি এটুকুই?

চলবে…

সাদিয়া সূচনা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here