তরুণ উদ্যোক্তা-ইয়াসিন আরাফাত

‌১৯৯৭ সাল। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় যমুনা নদীর তীরে ছোট্ট একটি গ্রামে তার জন্ম। পরিবারের চার ভাই বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মতোই কৃষি কাজের উপরেই তার পরিবার নির্ভরশীল। ফসলি জমি থেকে উৎপাদিত পণ্য আর ছোট একটি দোকান থেকে যা আয় হতো সেটা দিয়েই কোনরকম তাদের সংসার আর ভাই বোনের পড়াশোনা চলতো।

অভাবের সংসারে খুব ছোট থেকেই কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছে ইয়াসিন আরাফাতকে। ২০১৩ সালে যখন আরাফাত ক্লাস নাইনে উঠল ঠিক তখনই যমুনা নদীর করাল গ্রাসে ফসলি জমি বাড়িঘর ও দোকান সহ সব কিছু নদীতে বিলিন হয়ে যায়। পরিবারে উপার্জন করার মতো আর কোন পথ খোলা না থাকায় পড়াশোনা বন্ধ করে ঢাকাতে চাকরির উদ্দেশ্যে আসেন কিশোর আরাফাত। বয়সে ছোট হওয়ায় কোথাও চাকরি হয়নি। অবশেষে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের এক সেনাকর্মকর্তার বাসায় কাজ হলো। থাকা খাওয়ার খরচ বাদে মাত্র দুই হাজার টাকা বেতন দিতো মাসে।

আরাফাতের ভাষায়, ” আমি তখন ভীষণ কষ্ট পাই বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন কান্না আর চিন্তা করতাম বন্ধুরা সবাই  এসএসসি পরীক্ষা দিবে, সবাই কলেজে উঠবে। সবাই পড়াশোনা শেষ করে একদিন  বড় বড় অফিসার হবে আর আমি সারাজীবন মূর্খ থেকে যাবো শ্রমিকের কাজ ছাড়া ভাগ্যে কিছুই নেই আমার। তখন আমি ঠিক করলাম যদি আমি টাকার অভাবে পড়াশোনা না করতেও পারি তবুও আমি এমন কিছু করবো যাতে করে আমি অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকি এবং আমার সফলতার গল্পটা যেনো সবাইকে বলতে পারি এমন কিছু করবো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার কয়েক মাস পরেই গ্রামে চলে যাই এবং প্রতিদিন চিন্তা করি কি করা যায় কি এমন কাজ করলে একদিন আমি অনেক বড় কিছু করতে পারবো”।

নদীর তীরে বসে চিন্তায় মগ্ন থাকতেন সারাক্ষণ। হঠাৎ একদিন জেলেদের মাছ ধরার নৌকায় পাটের তৈরি কিছু রশ্মির টুকরো দেখে মাথায় চিন্তা আসে, পাট ছাড়া আর কি কি ম্যাটেরিয়ালস দিয়ে এই রশ্মি তৈরি করা যায়। তখন তার কাছে স্মার্টফোন ছিলো না, তাই চাইলেও গুগল করে কোন বিষয়ে জানতে পারাটাও একটু কঠিন। বিভিন্ন  বই ও পত্র পত্রিকার থেকে জানতে পারেন এবং তখনই  লেগে পরেন কিভাবে নতুন ভাবে নতুন সুতা দিয়ে আরো টেকসই ও মজবুত রশি মার্কেটে  আনা যায়। চাচার কাছ থেকে মাত্র ২০ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেন। ব্যবসার জন্য এক  জেলা থেকে আরেক জেলা ছুটে বেড়িয়েছেন। তীব্র শীতেও বাসের ছাদে উঠে গ্রাম থেকে ঢাকা আসতেন সুতা কিনতে। অচেনা শহরে এসে কত রাত ট্রাকের নিচে বস্তা বিছিয়ে ঘুমিয়েছেন সেটা হিসাবের বাহিরে”।

উল্লেখ বাংলাদেশে এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ডে প্রায় ১৩ লাখ শ্রমিক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১ কোটি ২৫ লাখ শ্রমিক খন্ডকালীনভাবে নিয়োজিত আছে শুধু মাত্র জেলে, কৃষি কাজ, বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের কাজ, ও পরিবহন সেক্টর সহ বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার রশ্মির প্রয়োজন হয় প্রতিনিয়ত।

মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে হাত মেশিন কিনে আর ১৫ হাজার টাকা ইনভেস্টে রশ্মি তৈরি করা শুরু করে দিলেন কিশোর উদ্যোক্তা আরাফাত। উৎপাদিত পণ্য গ্রামের ছোট ছোট বাজারে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করছেন। তারপর ব্যবসার লাভের অংশ জমিয়ে আরেকটা মেশিন। যেটা হাতে ঘুরিয়ে তৈরি করতে হতো কোন বিদ্যুৎ বা মটর ছাড়াই। আস্তে আস্তে গ্রামে যখন খুব ভালো একটা ব্যবসা দাড় করাতে সক্ষম হলেন  তখনই সব কিছু নিয়ে গাজীপুর চলে আসেন এবং সময়ের সাথে সাথে ২০ হাজার থেকে শুরু করা তার উদ্যোগে এখন  মোট পুঁজি ৩০ লক্ষ টাকা।

উদ্যোক্তা আরাফাত বলেন, “একটা হাতের মেশিন থেকে শুরু করেছিলাম এখন আমার কারখানায় উন্নত প্রযুক্তির ৮ টা মেশিন সহ ২৫ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি মাসে ১৫-২০ লক্ষ টাকার রশ্মি তৈরি হচ্ছে আমার কারখানায় এবং উৎপাদিত পণ্য সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। ৬ বছর আগেও আমি অন্যের বাসায় কাজ করেছি মাত্র ২ হাজার টাকা বেতনে, এখন আমি প্রতি মাসে ১ লক্ষ টাকার উপরে আয় করতে সক্ষম।

সম্প্রতি আইবিডি আয়োজিত সেরা নবীন উদ্যোক্তা ২০১৯ অনুষ্ঠানে ১২ হাজার উদ্যোক্তার মধ্যে থেকে টপ ৫ ছিলাম। মিডিয়া পার্টনার ছিলো চ্যানেল আই টেলিভিশন। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও আজ আমি একজন ইন্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট।  অন্যের বাসায় কাজ করার পরও আজ আমার কারখায় সমাজের অবহেলিত নারী সহ ২৫ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আমিই বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টসের পলেস্টর ওয়েস্ট রিসাইকল করে রশ্মি তৈরি করেছি। কথায় আছে, যে মানুষ জানে না কোন বন্দরে তার গন্তব্য, তার জন্য কোন বাতাসই অনুকূল না। কিন্তু আমি জানি, আমি স্বপ্ন দেখি একদিন হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থান হবে আমার কারখানায়। আর এটাই আমার পরবর্তী গন্তব্য”।

বিপ্লব আহসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here