সোনালী আঁশ পাট, যা কিনা এক সময় দেশের কৃষকের প্রধান অর্থকারী ফসল ছিল, হারানো সেই গৌরব ফিরিয়ে আনতে পাট থেকে দেশেই ভিসকস (রেশম) উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিসকোসের জন্য যে সেলুলোজ দরকার, সেটি পাটকাঠি থেকে কোনোভাবে বের করা যায় কি না সেই পরীক্ষা চলছে। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ফল ইতিবাচক হলে প্রতিবছর প্রায় হাজার কোটি টাকা আমদানি সাশ্রয় হবে।
পাট থেকে ভিসকস সুতায় তৈরি পোশাক অনেক আরামদায়ক এবং দামও বেশি। ভিসকস হলো সুতার প্রধান কাঁচামাল। এটি এক ধরনের রেশম, যা দিয়ে সুতা তৈরি হয়। ভিসকস দেখতে সুতার মতো কিন্তু সুতার থেকেও সূক্ষ্ম। ভিসকস ব্যবহার হয় তুলার বিকল্প হিসেবে সুতা তৈরির কাজে। এটি দিয়ে তৈরি সুতা হয় মিহি ও সূক্ষ্ম। এ সুতা দিয়ে তৈরি পণ্যের গুণগত মান বেশ উন্নত।
পাটের গৌরব ফিরিয়ে আনতেই পাট থেকে দেশেই ভিসকস (রেশম) উৎপাদনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এটি করা গেলে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা আমদানি সাশ্রয় হবে। বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্য ক্রয়ে ক্রেতাদের আগ্রহ থাকায় পাটজাতীয় ফাইবার হতে পারে পরিবেশবান্ধব প্রধান পণ্য।
২০১৯ সালের মধ্যে দেশে পাট থেকে সুতার প্রধান কাঁচামাল ভিসকস উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। ভিসকস ব্যবহার হয় তুলার বিকল্প হিসেবে সুতা তৈরির কাজে। বলা হচ্ছে, পাট থেকে ভিসকস বা রেশম তৈরি করা গেলে তা সোনালি আঁশের সম্ভাবনা আরো বহু গুণে বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) জানায়, ভিসকস উৎপাদনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্য যাচাই) তৈরি করার লক্ষ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আরও কিছু শুকনো পাতা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। ফিনল্যান্ডে ফিজিবিলিটি টেস্টের জন্য পাঠানোর পর তারা জানিয়েছে, এখনো এটা তেমন উপযোগী নয়। তাই এখন ভিসকোসের জন্য যে সেলুলোজ দরকার, সেটি পাটকাঠি থেকে কোনোভাবে বের করা যায় কি না সেই পরীক্ষা চলছে। আগে সেটা পাটের আঁশ থেকে করা হয়েছিল কিন্তু সে অনুযায়ী কোনো ভালো রেজাল্ট আসেনি, তাই দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করছে।
এ ছাড়া বর্তমানে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা তৈরিতে জড়িত চীনা প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে পাটখড়ি থেকে ভিসকোসিটির বিষয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা রয়েছে। এ পর্যন্ত ছয়টি চীনা, একটি জাপানিজ এবং একটি ব্রিটিশ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। পাটকাঠি থেকে চারকোল উৎপাদন পাটকাঠি থেকে চারকোল উৎপাদন পাটের বহুমুখী ব্যবহারের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় পাটের কাঠিকে ৮-১০ ঘণ্টা পুড়িয়ে কমপ্রেস করে চারকোল প্রস্তুত করা হয়। চারকোলে শতকরা ৭৫ ভাগ কার্বন থাকে। বর্তমানে ১৫টি কারখানায় চারকোল উৎপাদন হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রতি মাসে ৮০০ মেট্রিক টন চাল রপ্তানি করে দেশের ছয় কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। বাংলাদেশি ৩৫ লাখ মেট্রিক টন পাটকাঠি উৎপাদন হয়। পানি বিশুদ্ধকরণ প্রসাধনী, ফটোকপি ও কম্পিউটারের কালি তৈরির কাঁচামাল হিসেবে চারকোল ব্যবহৃত হয়। চারকোল রপ্তানি করে বছরে ৩১২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব।
আরো আশার খবর হচ্ছে পাট থেকে সুতার কাঁচামাল ভিসকস তৈরি এবং সেই ভিসকস থেকে তৈরি হচ্ছে ডেনিম কাপড়। প্রথমে পাট ও তুলার মিশ্রণে সুতা তৈরি করা হবে। সেই সুতা থেকে বানানো হবে ডেনিম কাপড়। উৎপাদিত কাপড় থেকে প্যান্ট, জ্যাকেট, শার্টের মতো পোশাক বানিয়ে রফতানি ও বেসরকারি খাতে কাপড় সরবরাহ করা হবে।
বিজেএমসি কর্তৃপক্ষ বলছে, পাটের আঁশ থেকে ভিসকস উৎপাদন আমাদের একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। আমরা পরীক্ষামূলকভাবে কিছু ভিসকস উৎপাদন করেছি। বড় পরিসরে ভিসকস উৎপাদনে একটি প্রকল্প প্রস্তাব একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদনের জন্য দেয়া আছে। যদি অনুমোদন পাওয়া যায় তাহলে পাটের আঁশ থেকে আরো একটি মূলবান পণ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। পাটের কদর আরো বাড়বে।
দেশে প্রতি বছর বস্ত্র কারখানাগুলোতে ৭০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টন ভিসকস সুতা আমদানি করা হয়।
বিজেএমসি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের বস্ত্র উৎপাদন কারখানাগুলো বছরে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ভিসকস আমদানি করে। এর মূল্য ৭০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা। এই ভিসকস আমরা নিজেরা উৎপাদন শুরু করলে আমদানি করার প্রয়োজন হবে না।
সরকারের এই সংস্থাটি বলছে, দেশে সুতা তৈরির কারখানা বাড়ছে। কাপড় উৎপাদনও বাড়ছে। পাট দিয়ে ভিসকস তৈরি ও বাজারজাতকরণ সফল হলে প্রতি বছর আমদানি সাশ্রয় হবে প্রায় হাজার কোটি টাকা।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা