উদ্যোক্তার জীবনের শুরুটা মোটেও সুখকর ছিলো না। জীবনের উন্নতির জন্য তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। বিদেশে কাটাতে হয়েছে একা, শুধুই একাকীত্ব। বন্ধু পাওয়ার জন্য ছিলেন মরিয়া। ভিন দেশে আবাসন সংকট ছিলো প্রকট। জায়গা না পেয়ে টানা তিন মাস কাটাতে হয়েছে একটি আলমারিতে। বাকিটা সময় শুধু কাজ আর কাজ। এভাবেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন নরওয়ের সফল উদ্যোক্তা ম্যাথিয়াস মিক্কেলসেন। তিনি দেশটির প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘মেমোরি’র প্রতিষ্ঠাতা।
ঘটনাটি আজ থেকে ঠিক সাত বছর আগে ২০১৩ সালের। ২৩ বছরের তরুণ উদ্যোক্তা ম্যাথিয়াস উড়াল দিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। ঘাঁটি গাড়লেন ক্যালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে, সম্পূর্ণ নিজ খরচে। লক্ষ্য ছিলো একটাই- তাঁর অনলাইন প্রকল্প ও সময় ব্যবস্থাপনার সরঞ্জাম নিয়ে ব্যবসার জন্য সমর্থন আদায় করা। প্রকল্পটির নাম ছিল ‘টাইমলি’।
সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়ায় গিয়ে শুরুতেই বড় একটি সমস্যায় পড়তে হয় ম্যাথিয়াসকে। সেখানে এমন একজনও পাননি, যাঁকে তিনি চেনেন, কিংবা জানেন। তবু তিনি সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উদ্যোক্তা বলেন, ‘সে সময় নরওয়েতে প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা শুরু করার মতো অবস্থা ছিলো না। তাই আমি বিশ্বের প্রযুক্তির রাজধানী খ্যাত সিলিকন ভ্যালিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই এটা ভেবে যে এটাই হবে আমার জীবনের জন্য সবচেয়ে উত্তম সিদ্ধান্ত’।
দূর পরবাসে একলা জীবনের অবসান ঘটাতে একটি সুচতুর পরিকল্পনা করলেন ম্যাথিয়াস। তিনি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকা এবং প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন জায়গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বুদ্ধিটা বেশ কাজে লাগলো। সময়ে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু জুটতে থাকলো তাঁর। ম্যাথিয়াস বললেন, ‘এভাবেই আমি বন্ধু বানাতে থাকলাম’।
পরিকল্পনাটি ভালোভাবেই কাজে লেগেছে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ম্যাথিয়াসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বন্ধু জুটে গেলো। কিন্তু এরপরের চ্যালেঞ্জটাও ছিলো কঠিন। একটি ‘হ্যাকার হাউস’ জোটানো। এটি সমমনা তরুণ প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের একটি আবাস, যেখানে অবস্থানকারী সবাই নিজ নিজ প্রকল্পকে ব্যবসায় রূপান্তর করতে চান। এই আবাসে সবাই সবাইকে সমর্থন জোগান, আদান–প্রদান করেন নিজের পরামর্শ, অনুপ্রেরণা ও যোগাযোগ।
শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সিলিকন ভ্যালিতে একটা আবাস খুঁজে পেলেন ম্যাথিয়াস। সেখানে ঘটলো আরেক বিপত্তি। ১৫টি বিছানার সব কটি অন্যরা নিয়ে গেলেন। তাই তাঁকে সেখানে থাকতে হলো একটি আলমিরাতে। সেখানে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সেখানে থাকতে হবে হাওয়াই বিছানায়। নেই জানালা। বর্তমানে ৩০ বছরের ম্যাথিয়াস বললেন, ‘আমি সুযোগটি লুফে নিলাম। সেই আলমারিতে তিনটা মাস কাটিয়ে দিলাম। সেখানে ঘুমাতে আমার মোটেও খারাপ লাগেনি’।
এই হ্যাকার হাউসই বদলে দেয় ম্যাথিয়াসের জীবন। সেখানে থাকার অভিজ্ঞতাটা ছিলো অসামান্য। সেখান থেকেই তিনি প্রকৃত উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন। উদ্যোক্তা বলেন, ‘আসলেই এটা ছিলো খুবই বড় একটা ব্যাপার, যার কোনো মূল্য নেই। সেখানে না থাকলে আজকে আমি যা, তা হতে পারতাম না’।
ম্যাথিয়াস মিক্কেলসেন একজন ব্যবসায়িক ডিজাইনার। মূলত Product Design, এবং Motion Graphics ( ক্লায়েন্টের লোগো লেখা বা চিত্রাদির নকশা সম্বন্ধীয় সুস্পষ্ট বর্ণনামূলক্ ধারণা তৈরী করা ) নিয়ে কাজ করেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রোডাক্ট ডিজাইন এবং পণ্য তৈরি করা, পাশাপাশি তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত apps গুলোকে আরো সৃজনশীল ভাবে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও যুগোপোযুগী উন্নত সংস্করণ তৈরী করাই হচ্ছে Memory (Timely) এর মূল কাজ।
Memory (Timely) বিশ্বের বড় বড় নামকরা ব্র্যান্ড কোম্পানির কেন্দ্রীভূত, আনন্দদায়ক সফ্টওয়্যার apps ভিত্তিক পণ্যগুলোকে আরও উন্নত করে গ্রাহকের সন্তুষ্টি অনুযায়ী সমাজে মানুষের জীবনে সচেতনতা মূলক স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে দিয়ে থাকে। এটি ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চালু হয়েছিল এবং বিশ্বজুড়ে কয়েক হাজার সংখ্যক সংস্থা এবং ফ্রিল্যান্সাররা এটি পছন্দ করে।
উদ্যোক্তা ম্যাথিয়াস মিক্কেলসেন বলেন ‘ আজ আপনি আমাকে ওসলো এবং সান ফ্রান্সিসকো / সিলিকন ভ্যালিতে একদিন বিশ্বের সেরা পণ্যগুলি নিয়ে আমাকে কাজ করতে দেখবেন।’
খুব দ্রুতই ম্যাথিয়াসের ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। তাঁর টাইমলি অ্যাপ আজ বিশ্বের ১৬০টি দেশের পাঁচ হাজারেরও বেশি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে।
নরওয়ের উত্তরাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করলেও ম্যাথিয়াসের বেড়ে ওঠা রাজধানী অসলোর বাইরের একটি শহরে। শৈশবে স্বপ্ন ছিলো একজন পেশাদার ফুটবলার হবেন। খেলবেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে। কিন্তু কৈশোরে এসে তার মত বদলায়। তিনি আবিষ্কার করলেন ফুটবলের চেয়ে তার মস্তিষ্ক বেশি কাজ করে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং নিয়ে। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করা অবস্থাতেই তিনি বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ওয়েবসাইট তৈরি করলেন। এ জন্য অর্থও পেলেন। তবে প্রথম দিকে এ কাজে তার মা-বাবা খুশি ছিলেন না, যে পর্যন্ত না তিনি তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ হাতে চেক পেলেন।
২০১৪ সালের শেষের দিকে ‘টাইমলি’ নিয়ে এগোতে থাকেন ম্যাথিয়াস। এক বছর পর তিনি তার ব্যবসাকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অসলোতে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিলেন। নতুন করে নাম দিলেন ‘মেমোরি’। ম্যাথিয়াস বলেন, ‘আমি যখন দেশ ছাড়ি, তখন এই শহরে প্রযুক্তি ব্যবসা চালু করার মতো অবস্থা ছিলো না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য অসলো এখন দারুণ জায়গা।’
মেমোরির এখন ৪৫ জন কর্মী। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক বিক্রির হার ২০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। ম্যাথিয়াস তার ব্যবসার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছেন ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।
সাহস আর সুযোগের সদ্ব্যবহারের কারণেই আজ এত দূর ম্যাথিয়াস। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে ম্যাথিয়াসের মতো উদ্যোক্তাদের কিছু সহজাত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তাঁরা ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেন। সুযোগ পেলে লুফে নেন।
সহজাত বৈশিষ্ট্য আর সুযোগ কাজে লাগানোর কারণেই আজকে সুপ্রতিষ্ঠিত ম্যাথিয়াস। তবে সিলিকন ভ্যালির সেই হ্যাকার হাউসের দিনগুলো আজও ভোলেননি তিনি। পরিশেষে উদ্যোক্তা বলেন, ‘এটা ছিলো সত্যিই উথাল–পাতাল একটা সময়। যা খুবই অস্থির। আমি প্রতিদিন প্রতিটি মিনিটকে কাজে লাগিয়েছি। তাই সত্যি বলতে, সেই তিনটা মাস আমি কোথায় ঘুমিয়েছিলাম, তা আমার মাথাতেই ছিল না’।
(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)