তারেঙ নিয়ে উদ্যোক্তা ত্রিশিলার এগিয়ে চলা

0
উদ্যোক্তা ত্রিশিলা

আদিবাসী মেয়েটার নাম ত্রিশিলা চাকমা, তার উদ্যোগের নাম তারেঙ। এটি একটি চাকমা শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ‘পাহাড়ের ঢালু অংশ’। এই নাম রাখার পেছনে একটা গল্প আছে।

চাকমাদের মধ্যে আসলে ব্যবসা নিয়ে একটা সামাজিক ধারণা আছে যে, চাকমারা ব্যবসা করতে জানে না। কাজেই উদ্যোগ যখন নিচ্ছিলেন তখনও জানা ছিল না ঢাল বেয়ে শিখরে উঠতে যাচ্ছেন নাকি গড়িয়ে পড়তে যাচ্ছেন। তবে সাড়ে তিন বছরের উদ্যোগ জীবনে মনে হচ্ছে উদ্যোক্তা তার তারেঙ বা বাংলায় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আসলে উপরে উঠছেন।

উদ্যোক্তা ত্রিশিলার জন্ম রাঙামাটিতে হলেও উন্নত শিক্ষার খোঁজে তার বাবা মা স্কুলে পড়াকালীন রাঙামাটির বাইরে পাঠিয়ে দেন। ভারতেশ্বরী হোমস্ স্কুল এরপর ঢাকার হলিক্রস কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার পর ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিক থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্ব শেষ করেন উদ্যোক্তা ত্রিশিলা। রাঙামাটিতে যে উচ্ছলতায় ছোটবেলা কেটেছিল সেই আবেগ কিন্তু কখনো ভুলেন নি।

রাঙামাটির যে পরিবর্তন, বিশেষ করে অনেক দিন পর পর যখন ছুটিতে ঘরে যেতেন পার্থক্য টা খুব করে চোখে ধরা দিতো আর খেয়াল করতেন আদিবাসীদের যে আদি ঐতিহ্য তা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতা ও উন্নয়নের অজুহাতে। তখন থেকেই উদ্যোক্তার খুব ইচ্ছে করতো তাদের সাংস্কৃতিক ও জীবনের ভিন্ন দিক গুলো তাদের বাকি সবার থেকে আলাদা করেছে, সেগুলো কিভাবে সংরক্ষণ করা যায়।

উচ্চ শিক্ষার পরে বাকি সবার মত উদ্যোক্তা ত্রিশিলাও শিক্ষানবিস হিসেবে আদালতে কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এরপর নানা এনজিওতে শিক্ষানবিস হিসেবে মানবাধিকার বিষয়ক নানা প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু কোথাও স্থায়ী ভাবে চাকরি করার আগ্রহ পান নি। অবশেষে একটি প্রাইভেট কোম্পানির অপারেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করার সময় পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চল গুলো স্বশরীরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়।

তখন খেয়াল করেন শহরের ছোঁয়া গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ার মুখে। অর্থাৎ, গ্রামে যা একটু আদি ঐতিহ্য গুলো চর্চা হতো সেগুলোও হারিয়ে যাওয়ার পথে চলতে শুর করেছে। তখন আসলেই তিনি নিজের মধ্যে একটা শেকড়ের টান অনুভব করেন। তখন মনে হলো যদি এখনই কিছু না করেন তাহলে আর কখনো করা হবে না। তখন তিনি মাত্র তরুণ, এমন একটা কাজের দরকার ছিল যেটা দিয়ে আয়ের একটা উপায় বের হবে আবার মানুষের মধ্যে আদিবাসী সংস্কৃতির মূল্যবোধ ও ফিরিয়ে আনা যাবে।

২০১৭ সালের ৩১ শে অক্টোবর ৫ জন সমমনা বন্ধু নিয়ে শুরু করি তারেঙ উদ্যোগটি। প্রথম দিকে ঘর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই উদ্যোগ শুরু করলেও পাঁচমাসের মাথায় তারা আউটলেট নিতে সক্ষম হোন। যেহেতু উদ্যোগের উদ্দেশ্য তাদের মাঝে আদি সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনা তাই তাদের পণ্যগুলো সব পার্বত্য অঞ্চলের ছোঁয়া দেখা যায়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম কে প্রভাবিত করতে তারা এখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পোশাক টিশার্ট কে বেছে নেন সিগনেচার প্রোডাক্ট হিসেবে। টিশার্টের উপর স্ক্রিনপ্রিন্টের মাধ্যমে তারা মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জীবন চরিত তুলে ধরেন। এছাড়া বাঁশের পণ্যকে শৈল্পিক আকার দিয়ে প্রচার করছি, পার্বত্য অঞ্চলে প্রাকৃতিক বনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার জন্য। একটা সময় পার্বত্য অঞ্চল বাঁশ পণ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল, অথচ এখন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার মূল উপাদান বাঁশই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

উদ্যোক্তার উদ্যোগ যেহেতু আদি বস্তু গুলো নিয়ে, সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় এর উপকরণ এবং তথ্য গুলো সংগ্রহ করতে। দেখা যায় যারা আদি ঐতিহ্যময় সময়টাকে স্বচক্ষে দেখেছেন তারা হয় মারা গেছেন, অথবা অনেক বয়স হয়ে গেছে যে বিষয়টি নিয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারছেন না। যেমন এই পার্বত্য অঞ্চলে একটা সময় ‘বার্গী’ নামে এক প্রজাতির পাখির আধিক্য ছিল। পুরনো পুঁথি, গান, শ্লোকে এ পাখির উপস্থিতি দেখতে পাই, কিন্তু এই পাখি দেখতে কেমন ছিল সেই তথ্য আমরা এখনো বের করতে পারি নি। আসলে এই তথ্য গুলো পাওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং ব্যায়বহুল। সে অনুযায়ী আমাদের টিশার্টের মূল্য কিন্তু খুব একটা বেশি না।

মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের বাজেট ফ্রেন্ডলি চিন্তা করতে হয় যেন টিশার্টটি সবার কেনার সামর্থ্যের মধ্যে থাকে। তাই সময়ের সাথে আমাদের সদস্যদের মধ্যেও রদবদল হয়। এখন তিনজন তারেঙ’কে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছেন। তার মাঝে উদ্যোক্তা ত্রিশিলা ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে সম্মুখে থেকে কাজ করছেন।
সন্তুষ্টির বিষয় হচ্ছে তাদের পণ্য গুলো দেশের বিভিন্ন জেলায় তো নিয়মিত যায়, এছাড়া নানা সময় বিশেষ করে চৈত্র সংক্রান্তির সময় দেশের বাইরে থেকেও তারা অর্ডার পেয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত ফ্রান্সে, কানাডায় এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় টিশার্ট পাঠিয়েছেন।

তারেঙ এর শুরু হয়েছিল আদি ঐতিহ্যকে আধুনিকতার মাঝেও ধরে রাখার একটা প্রত্যয় নিয়ে, এটা সবসময়ই থাকবে। উদ্যোক্তা তাদের আয়ের একটা অংশ দাতব্য প্রতিষ্ঠানে এবং তরুণ দের নানা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অনুদান হিসেবে প্রদান করে সামাজিক দায়িত্ব পালন করছেন। উদ্যোক্তা পরিশেষে জানান, “শুধুমাত্র চাকরি করাই তরুণদের একমাত্র পেশা নয়, উদ্যোক্তা হয়েও ক্যারিয়ার গড়া যায়।”

মাসুমা সুমি,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here