তানিয়ার ‘দেশি বুনন’-এ তাঁতের প্রতি ভালোবাসা

0
উদ্যোক্তা - তানিয়া সারোয়ার

শাড়ির মতো নারীসুলভ পোশাক পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাঙালি নারী বললে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাড়ির আচ্ছাদনে আবৃত মোহনীয় স্ত্রী প্রতিমা। অনেক সময় পোশাক মানুষকে প্রকাশ করে। অনেক দেশের প্রতিনিধি বহুজাতিক কোনো অনুষ্ঠানে একজন বাঙালি নারীর ‘শাড়ি’ পোশাক দেখে সহজেই বলে দিতে পারেন তিনি বাঙালি। নারীর এই প্রিয় পোশাকটি খুব বেশি দিন হয়নি ভারতবর্ষে এসেছে। তবে এদেশে তাঁত শিল্পের ইতিহাস কিন্তু কিছু কম পুরনো নয়।

আবার শাড়ী পরার কৌশলেও এসেছে ব্যাপক বিবর্তন। বারো হাত লম্বা একটি সেলাইবিহীন কাপড়কে সুকৌশলে নিখুঁতভাবে গায়ে জড়িয়ে নেওয়ার শৈল্পিক সৌন্দর্য শুধু বাঙালি নারীরাই জানে। আবার এই বিশাল কাপড় শরীরে জড়িয়ে সব কাজ করার ক্ষমতা শুধু নারী মানে বাঙালি নারীরাই জানে। শাড়ী পরার আধুনিক যে কৌশল বর্তমানে চালু আছে তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ির মহিলারই প্রথম প্রবর্তন করেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের শাড়ীর প্রচলন থাকলেও সবার পছন্দের শীর্ষে ঢাকাই জামদানি। এমন আরামদায়ক রুচিশীল শাড়ি আর নেই।

এই জামদানী শাড়ী নিয়ে কাজ করছেন উদ্যোক্তা তানিয়া সারোয়ার। সকলেই যেনো সাধ্যের মধ্যে জামদানী শাড়ী কিনতে পারেন, সে-জন্য এ-নিয়ে নতুন নতুন ডিজাইন আর নানা রকম হিসেব কষেন উদ্যোক্তা। গত দুই বছর ধরে বাংলার জামদানী যে নতুন সাড়া ফেলেছে তার মাঝে তিনিও আছেন তার জামদানীগুলো নিয়ে। করোনায় অনলাইনের জামদানী সেলের মাধ্যমেই তাঁতীদের চিত্র পাল্টে যায়। বিশ্বজোড়া সংকটের সময়ে যে ধরনের বিপর্যয়ের আভাস ছিলো তাঁতীপাড়ায় তার অনেকটাই কেটে যায় এই বিপ্লবে। ধারনার অনেক বেশি বাইরে গিয়ে সাফল্য এসেছে উদ্যোক্তার ব্যবসায় এবং তাঁতীদের ঘরে। যার অনেকটা ফোকাস এসেছিল উই গ্রুপে জামদানী ওয়েভের মধ্য দিয়ে ৷ ব্যবসার শুরুতে উদ্যোক্তা ৫০০০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। বিদেশী পণ্যের ৫ বছরের পুরোনো ব্যবসাকে ছাপিয়ে নতুন জায়গা করে নেয় তানিয়া সারোয়ারের জামদানী। আর সেখানেই থিতু হলেন উদ্যোক্তা। করোনার আগে উদ্যোক্তার ব্যবসা বেশ ভালো চলছিলো প্রতি মাসে আয় হতো ৬০,০০০ টাকা থেকে ৭০,০০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু গত দেড় বছরে উদ্যোক্তার আয়ের মাত্রা দাঁড়িয়েছে এই কোরোনাকালীন সময়ে প্রতি মাসে ৩০,০০০ টাকা থেকে ৪০,০০০ টাকা পর্যন্ত। করোনাকালীন সময়ে মাত্র ১ জন সহকর্মী কে সাথে নিয়ে উদ্যোক্তা তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

বর্তমানে উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়-এর সমস্ত কার্যক্রম দেশ ও দেশের বাইরে অফলাইন-অনলাইনে চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি উদ্যোক্তার পণ্য আমেরিকা, লন্ডন, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া-সহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে নিয়িমিত বিক্রি হচ্ছে।

গত ৬ বছর থেকে ব্যবসায় করছেন তানিয়া সারোয়ার। প্রথমে ইন্ডিয়ান প্রোডাক্ট নিয়ে জমজমাট ব্যবসায় চলছিলো তার। অনলাইনে এবং অফলাইনের অর্ডারে সারাদিন দম ফেলার সুযোগই যেন পাওয়া ভার। কিন্তু বিশ্বজুড়ে আঘাত হানা করোনার মহামারীতে পাল্টে গেল ব্যবসার চিত্র। তিলেতিলে বেড়ে উঠা দেশিয় পণ্যের ভবিষ্যত নিয়ে সকলেই সন্ধিহান। আর হবেই বা না কেন! যে মহামারীর সম্মুখীন হয়েছি আমরা তাতে নিজের অস্তিত্ব থেকে শুরু করে সবখানেই ভয়টা স্বাভাবিক। নিজের মাঝেও চিন্তা এলো দেশীয় পণ্য নিয়ে কিছু করার। মনের মাঝে উদিত হওয়া তাড়না থেকে তাঁতীদের খোঁজ নিতে লাগলেন। জামদানী নিয়ে আগে থেকেই অনেক বেশি আগ্রহ ছিলো তার। আর তাই তাঁতীদের সাথে পরিচয়। শুরু হলো নতুন স্বপ্নের পদযাত্রা।

অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের সময় থেকেই একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াতেন। এরপর থেকে স্বাবলম্বী হয়ে পথ চলা শুরু। এরপর বিয়ে, প্রথম সন্তানের জন্ম, দ্বিতীয় সন্তানের আগমন বার্তা। হঠাৎই গর্ভকালীন অসুস্থতায় চাকরিটা ছেড়ে দিতে হলো। এরপর সন্তানের জন্ম, সাংসারিক ব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে আবারো কাজের শুরু। কিন্তু এবারে কারো অধীনে চাকরি নয়, নিজের একটি পরিচয়, নিজের ব্যবসায়কে নিয়ে পথ চলার সূচনা। আর সেই সূচনার আরেক অংশের নাম তানিয়া সারোয়ারের ‘দেশি বুনন’। নিজের স্বাবলম্বী হয়ে উঠা নিয়ে বরাবরই সচেতন একটা মনোভাব ছিলো। খুতখুতে একটা অনুভূতি, নিজের হাত খরচের টাকা, শখের একটা ঘর সাজানোর জিনিস, নিজের প্রসাধনীর টাকাটার সংস্থান নিজেকেই করতে হবে। সেই সাথে সংসারে টুকটাক খরচাপাতিও যোগাতে হবে জীবনসঙ্গীর সাথে। দেশীয় পণ্যের প্রতি তাগিদ আর নিজের খরচের টাকা যোগানোর তাড়না মিলেমিশে এক হয়ে ধরা দিয়েছে সফল উদ্যোক্তার নামের পাশে।

ভবিষৎ তরুণ উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে অভিমত জানতে উদ্যোক্তা বলেন, ‘ব্যবসায়-বাণিজ্যে নারীর অবদান বাড়ছে। আমাদের সমাজে সামাজিক ও পারিবারিক বাধা এখন আর নেই। নিজেকে তৈরী করে, কর্মক্ষম করে, সামনের দিকে এগিয়ে যান সাফল্য আসবেই’।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক কেটেছিল সিলেটে ৷ বাবার সাথে মনিপুরী পাড়ায় যাতায়াত থেকে সে সময় নিজের জন্য দু’টো শাড়ি কিনেছিলেন। সেই শাড়িও যেন বহুবছর পর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে নতুন কিছু করার। যদিও করোনার মাঝে লকডাউনে যাতায়াত নিষেধাজ্ঞায় ঠিকমতো তাঁতীদের কাছে গিয়ে কাজের সুযোগ ছিলো না। ফলে মনিপুরী নিয়ে কাজটা সেভাবে বেগবান করা সম্ভব হয়নি আর। তাতে কী! সুরক্ষা আর সকল বিধি নিশ্চিত করে জামদানী নিয়ে তো কাজ করা গেছে এতেই সোনায় সোহাগা হয়েছে দেশি বুননের অগ্রযাত্রা। দেশিয় পণ্য নিয়েই কাজ করে যেতে চান তানিয়া সারোয়ার।

সাদিয়া সূচনা
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here