কাঠের ব্যবসা করতে গিয়ে প্রাথমিক ভাবে ধাক্কা খেলেন এক তরুণ। মনোবল হারিয়ে ফেললেন নতুন কাজের জন্য। এই সময় পাশে দাঁড়ালেন তার স্ত্রী। শুধু ভরসাই দিলেন না, নিজের গহনা বিক্রি করে দিলেন ৩০ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে একটি ছোট্ট উদ্যোগ শুরু করলেন স্বামী।
ব্যাগ বানানো শুরু করলেন তিনি। যাত্রা শুরু সেখান থেকেই। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে গিয়েছিলেন বিসিকে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য। আজ দুজনে মিলে তৈরি করছেন ব্যাগ, উপজাতিদের জন্য রং-বেরঙের পোশাক।
২০০৭ সাল, কাঠের ব্যবসা করতে গিয়ে ভীষণ ভাবে মনোবল হারালেন এক তরুণ। সে সময় দাঁড়ানোর মতো আর কোনো অবস্থান ছিল না তার। একদম অসহায় একটা অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি।
তার এক কাছের বন্ধু সেলিম তাকে তাঁত এবং হস্তশিল্পের ব্যবসা শুরু করার পরামর্শ দিলেন। তার সহধর্মিণী দিলেন গহনা বিক্রি করে সমস্ত টাকা । রাঙ্গামাটি বিসিক থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলেই ট্রেনিং নিলেন।নিজের ঘরেই দুটো তাঁত বসালেন, ব্যাগ বানানোর কাপড় তৈরি শুরু করলেন। দুইজন তাঁতের কারিগর, দুজন সুতার কারিগর এবং স্ত্রী নুরজাহান বেগম নিজেও এগিয়ে এলেন উদ্যোক্তার পাশে। কাপড় তৈরি করতে লাগলেন স্বামী স্ত্রী ও তাদের কর্মী বাহিনী। দুই তিনটি করে ব্যাগ তৈরি শুরু হলো প্রতিদিন।
যেদিন ৫০ টি ব্যাগ তৈরি হলো দোকানে দোকানে নিয়ে গেলেন মোহাম্মদ শফি। পাহাড়ে কাপড়ের তৈরি ব্যাগ, হ্যান্ড ব্যাগ, পার্স, ভ্যানিটি ব্যাগ। 50 টি ব্যাগের লাভ আসল মাত্র এক হাজার টাকা। এই টাকাকেই ভীষণ বড় শক্তি হিসেবে দেখলেন দুইজন। আবার নতুন করে সুতা কেনা হল। এবার সাতটি ব্যাগ তৈরি হলো। একের পর এক নতুন কাজ। নতুনভাবে যুক্ত হলো উপজাতী পোশাক। পোশাক বানানোর সঙ্গে সঙ্গেই ৫০০ পিস পোশাক বিক্রি হয়ে গেল। মাত্র দেড় বছরেই তরুণের মূলধন দাঁড়ালো সাড়ে চার লক্ষ টাকা।
এইবার মন দিয়ে আরও নতুন স্পৃহা নিয়ে নতুনভাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন উদ্যোক্তা। শীতলপাটিকে কাজে লাগাতে শুরু করলেন উদ্যোক্তা । ২০০৯ সালে পার্স ব্যাগ এবং ভ্যানিটি ব্যাগ তৈরি হলো শীতলপাটি থেকে। প্রচন্ড ডিমান্ড হয়ে গেল এই ব্যাগের। মাত্র চারটি মাসে ৫০০ পিস, থেকে ৮০০ পিস, তারথেকে ১০০০ পিস এবং সর্বোচ্চ ২০০০ পিস শীতলপাটির ব্যাগ অর্ডার আসে উদ্যোক্তার কাছে। উদ্যোক্তা এগিয়ে যেতে থাকেন সামনের দিকে।
চারজন নারী কর্মীকে নিয়ে শুরু করা উদ্যোগ এখন ৪০ জন কর্মী নিয়ে উৎপাদন হতে থাকে উদ্যোক্তার পণ্য। উদ্যোক্তা তার কর্মের ভুবনকে শক্তিশালী করছেন নতুন নতুন পণ্যের মাধ্যমে। নিত্য নতুন পণ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন উদ্যোক্তা।
বাচ্চাদের থামি সেট, বড়দের ওয়ান পিস, কামিজ,ছোটদের ওয়ান পিস, কামিজ, ফ্রগ,ফতোয়া, কুর্তি, বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের পার্টস, কাপড়ের বড় ব্যাগ সহ অসংখ্য পণ্যের উৎপাদন হতে থাকে উদ্যোক্তার ভুবনে। সকাল আটটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত 16 ঘণ্টা কাজ করেন উদ্যোক্তা নিজেই। পণ্যের উৎপাদন, মাননিয়ন্ত্র, রং, সেলাই, ডিজাইন সবকিছু নিয়ে চলে কর্মযজ্ঞ চলে গবেষণা।
স্ত্রী, তিন সন্তান সকলেই যেন উদ্যোক্তার শক্তির এক একটি উৎস। সার্বক্ষণিক পাশে ছিলেন তার স্ত্রী, জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার অংশও তিনি।
একটানা ১০ বছরের পরিশ্রমে প্রোডাক্ট লাইনে যোগ হলো ১০০ ডিজাইনের এবং ক্যাটাগরির পণ্য। সারা দেশ জুড়ে বিক্রি হতে থাকে উদ্যোক্তার পণ্য। ২০২১ সালের মহামারীর পর উদ্যোক্তা নিয়ে আসলেন নতুন ডিজাইনের স্যান্ডেল, পাটির স্যান্ডেল।দেশের প্রথম পাটির স্যান্ডেলের কনসেপ্ট নিয়ে আসেন উদ্যোক্তা তার কারখানায়।লকডাউনের পর পরই ৩০০০ জোড়ার অর্ডার আসে উদ্যোক্তার ভুবনে। উদ্যোক্তার ভুবনে কাজ করছে এখন ৫০ জন কর্মী । আশেপাশের বিভিন্ন বাড়িতে ব্যাগ স্যান্ডেল এবং নানান ধরনের কাজ নিয়ে যান মহিলারা।
একে একে অর্ডার আসতে থাকে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড এবং জার্মানী থেকে। জীবনের কোন বাধায় যেন তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। দ্বিগুণ শক্তি আর সাহস নিয়ে হয়ে উঠেছেন পরিবেশবান্ধব এক উদ্যোক্তা। একজন সফল এসএমই উদ্যোক্তা।
মার্জিয়া মৌ,
উদ্যোক্তা বার্তা।