ছোট ব্যবসা শুরু করার সঠিক সময়

1

একটি উদ্যোগ গ্রহণ বা ব্যবসা শুরু করা কখনও সহজ ব্যাপার নয়। আবার এটি যে অসম্ভব কিছু, তেমনও না। আপনাকে জানতে হবে আপনি কী পরিষেবা বা পণ্যের অফার বা সুবিধা দিতে যাচ্ছেন। ব্যবসাটি শুরু করার সঠিক সময় সম্পর্কেও আপনাকে জানতে হবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশে তেমন কোন গবেষণা না থাকলেও ভিস্তাপ্রিন্টের সমীক্ষা অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬২ শতাংশ মানুষ ব্যবসার মালিক হতে চান। এখানে কিছু কম-বেশি হলেও শতাংশের হিসাবে তা কাছাকাছিই কিছু একটা হবে। কিন্তু, আসলে কতোজন জানেন একটি ব্যবসা শুরু করা থেকে তা পরিচালনা বা উদ্যোগটি সম্প্রসারণে কী লাগে এবং তাদের জীবনের এ পর্যায়ে এটা কি শুরু করার সঠিক সময়?

‘দ্য ব্যালেন্স’-এর সাথে ইমেইল সাক্ষাতকারে ‘নেটওয়ার্ক ফর উইমেন ইন বিজনেস’-এর প্রতিষ্ঠাতা টনি কোলম্যান ব্রাউন বলেছেন: সব উদ্যোগ বা ব্যবসায়িক ধারণাই অনন্য এবং অসাধারণ হয় না। আবার তা শুধু একজনের জন্যও নির্ধারিত নয়। উদ্যোগ নেওয়ার পর সেটিতে মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করতে হবে, যে কাজ করে সে-ই জয়ী হয়।

উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা শুরু করার অনেক কারণই নিজের মনে লালন করেন এবং তা উল্লেখ করেন। এর মধ্যে থাকে তার বর্তমান চাকরি ভালো না লাগা কিংবা সৃজনশীল কিছু করার স্বপ্ন। কিংবা শুধুমাত্র আরও অর্থের আকাঙ্খা থেকেও অনেকে ব্যবসার উদ্যোগ গ্রহণ করেন যা স্বাভাবিক এবং ন্যায্য। নতুন উদ্যোগের পেছনে এরকম যে কারণই থাকুক না কেন, উপযুক্ত সময় এবং ব্যবসা শুরুর কারণটা নিজের জানা খুব জরুরি।

এখানে এরকম কিছু পদক্ষেপ এবং বিবেচনার কথা উল্লেখ করা হবে যা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন আপনার ব্যবসাটি সফল করার জন্য আপনার উদ্যোগটি সময়োপযোগী এবং সঠিক পথে আছে কি না:

সম্ভাব্য ভোক্তা চিনতে গবেষণা
প্রথমেই আপনাকে গবেষণা করে খুঁজে বের করতে হবে যে কারা আপনার পণ্য বা পরিষেবার সম্ভাব্য ভোক্তা এবং তাদের সংখ্যাই বা কতো হতে পারে। কোন শ্রেণির মানুষ আপনার পণ্য বা সেবা থেকে বেশি উপকৃত হবেন, সেটাও আপনাকে জেনে নিতে হবে। আপনি যে লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন সে বিষয়েও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা জরুরী।

স্টার্টআপকেন্দ্রিক সাইট ‘ফেইলরি’র গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তা ব্যবসার শুরুতেই ব্যর্থ হন। গবেষণায় পাওয়া কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পণ্য বা সেবাটি নির্বাচিত বাজারের জন্য উপযুক্ত ছিল না।

‘স্মল বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’-এর মতে, বাজার শনাক্ত করে উদ্যোক্তার সামর্থ্য অনুযায়ী লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বাজারে টিকে থাকার চাবিকাঠি হচ্ছে:
• বাজার গবেষণা যেমন সম্ভাব্য ভোক্তার বয়স, মোট জনসংখ্যা এবং গড় সম্পদের তথ্য সংগ্রহ করা।
• ভোক্তার আচরণ এবং অর্থনৈতিক প্রবণতা বিশ্লেষণ করা।

ছোট ব্যবসা শুরু করার প্রকৃষ্ট উদাহরণ
আমরা উইনি অ্যান্ড কো. এর নাম জানি। এর প্রতিষ্ঠাতা জাজমিন থম্পসন। তার মেয়ের চুলের জন্য সঠিক ময়েশ্চারাইজার খুঁজে না পেয়ে তিনি নিরামিষাশী হেয়ার কেয়ার ব্র্যান্ড উইনি অ্যান্ড কো. প্রতিষ্ঠা করেন।

‘দ্য ব্যালান্স’-এর সাথে ফোন সাক্ষাতকারে থ্ম্পসন বলেন, “আমি যখন আমার মেয়ের চুলের যত্ন নিয়ে সমস্যায় পড়ি, তখন আমার মনে হয় এই সমস্যায় নিশ্চয়ই অন্য মায়েরাও ভুগছেন। তখন আমি ছোট বাচ্চাদের জন্য ভেগান-ভিত্তিক চুলের পণ্যগুলো নিয়ে চিন্তা করি।”

থম্পসন এ বিষয়ে অন্য মায়েদের মতামত ও প্রতিক্রিয়া জানতে ফেসবুকে প্যারেন্টিং গ্রুপের সদস্য হয়ে যান, অন্য মায়েদের সমস্যার কথা জেনে তাদের মত নিতে শুরু করেন। এটি তার চিন্তা ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং ব্যবসা শুরু করতে অনুপ্রাণিত করেছিলো।

টার্গেট মার্কেটে আইডিয়া যাচাই
আপনার যদি একটি ব্যবসা বা উদ্যোগের চিন্তা মাথায় থাকে কিন্তু এটি সফল হবে কি না সে বিষয়ে যদি নিশ্চিত না হন; তাহলে আগে চারপাশের মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করে নিন।

২০১৯ সালে ডোপেলি লিটের মালিক টোনিটা হোয়াইট সয়া-ভিত্তিক এক ধরণের সুগন্ধি মোমবাতি বিপণনের চিন্তা করেন। কিন্তু, পণ্যটি মানুষ নেবে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত না থাকার কারণে হোয়াইট বুঝতে পারলেন, তার একটি সৃজনশীল আউটলেট প্রয়োজন।

তিনি বলেন: আমি এমন কিছু হতে চেয়েছিলাম যা আমি ভালোবাসি এবং উপভোগ করি।

দুই যমজ বাচ্চার মা হোয়াইট প্রথমে দুটি সুগন্ধি দিয়ে বাজার যাচাই করেন। এরপর সরবরাহের জন্য বাজেট করে ভ্রাম্যমাণ অস্থায়ী দোকান খুলেছিলেন। যখন তার পণ্যগুলো ভোক্তারা পছন্দ করতে শুরু করেন, তখন ২০২০ সালে তিনি তার ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তিনি তার ব্যবসার জন্য একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট চালুর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও উপস্থিতি নিশ্চিত করেন। পাশাপাশি ‘হলিডে সুগন্ধি’ মোমবাতি বাজারে এনে পণ্যে ভিন্নতা দিয়ে তার ব্যবসাকে আরও প্রসারিত করেন হোয়াইট। এখন তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী।

সময়-শক্তি-সম্পদ
আপনি যদি একটি নতুন ব্যবসা শুরু করতে চান বা নতুন একটি উদ্যোগ নিতে চান তাহলে তিনটি বিষয় মাথায় রাখা খুব জরুরি:
 আপনি উদ্যোগটির জন্য কতোটুকু সময় দিতে পারবেন।
 কঠিন সময় মোকাবিলার জন্য আপনার মানসিক শক্তি এবং সামর্থ্য আছে কি না। এবং
 ছোট কিংবা বড়– বিনিয়োগ যাই হোক না কেন সেটার সংস্থান কীভাবে হবে।

আপনি হয়তো নতুন ব্যবসার জন্য খুবই উদ্যোগী, কিন্তু নিজের সম্ভাব্য সময় বিনিয়োগের বিষয়টি আপনাকে মাথায় রাখতেই হবে। ধরা যাক, আপনি একক পরিবারের মানুষ এবং ছোট এক বা একাধিক সন্তানের মা। কিন্তু, আপনার এলাকায় শিশুযত্ন কেন্দ্র নেই। তাহলে সন্তান এবং ব্যবসা দুটো’র জন্যই আপনার সময় ব্যবস্থাপনা কী হবে সেটা আগেই বুঝে এবং ঠিক করে নিতে হবে। আপনার নিজেকে এবং পরিবারকে উদ্যমী রাখার ব্যবস্থাটাও মাথায় রাখতে হবে।

ব্যবসা কৌশল সম্পর্কিত প্রশিক্ষক এবং ‘কিংডম লিগ্যাসি পার্টনারশিপস’-এর প্রতিষ্ঠাতা তেরেসা স্যাচেল বলেন, “ধৈর্য্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও প্রাত্যহিক জীবন এবং ব্যবসার মধ্যে টানাপোড়েন আসতে পারে। কিন্তু, দু’ দিকেই সমন্বয় করতে হবে। কোনভাবেই থেমে যাওয়া চলবে না।”

সেই না থামার মিশনে আগে থেকেই আর্থিক পরিকল্পনা রাখা প্রধানতম একটি কাজ। ব্যবসা উদ্যোগ শুরুর করার আগে মনে রাখুন:
 আপনার ব্যবসায় মূলধন যোগানোর জন্য আপনি কত টাকা সঞ্চয় করেছেন?
 আপনার ঋণের কী অবস্থা? এটি আপনাকে আপনার ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করবে নাকি বাধা দেবে?
 আপনার ব্যাংকিং অবস্থা ভালো না হলে সেটা তৈরি করতে আপনাকে কী করতে হবে যাতে আপনি আপনার ব্যবসা পুরোপুরি চালু করতে প্রস্তুত হতে পারেন।
 আপনার ব্যবসায় অর্থায়নের জন্য আপনার কী পরিমাণ প্রারম্ভিক মূলধন প্রয়োজন?
 আপনার ব্যবসার খরচ কী কী?
 এই ব্যবসাটি হলে কীভাবে তা আপনার ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে সাহায্য করবে বা ক্ষতি করবে (বিশেষ করে যদি আপনি ব্যবসাটি শুরু করার জন্য আপনার চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসে থাকেন।)

নেটওয়ার্কিং
পণ্য বা সেবার বাজার নিয়ে আপনার নেটওয়ার্কিং পরিকল্পনাটাও খুব জরুরি। বিশেষ করে ডিজিটাল এ সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যখন অনেককিছুর গতিপথ ঠিক করে দিচ্ছে। অন্যদের সাথে নেটওয়ার্ক করার ক্ষমতা যেমন আপনার থাকতে হবে, তেমনি শিল্প-সম্পর্কিত পেশাদার সংস্থাগুলোর মতো সামাজিক চ্যানেলগুলো বুঝে সেগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহারের পরিকল্পনা ও যোগ্যতাও একটি ব্যবসা শুরু করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷

স্যাচেল বলেন: একটি ব্যবসা শুরু করার আগে, সঠিক পছন্দ বেছে নিতে সাহায্য করার জন্য একজন ব্যবসায়িক পরামর্শদাতার সাথে কথা বলুন। উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তা একটি যাত্রা শুরুর পর ভ্রমণের মতো। সঠিক অংশীদারিত্বের লোকেদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারলে তা আপনাকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে যাবে। আপনাকে সঠিক লোকেদেরতে চিনতে হবে, তাদের সাথে দেখা করতে হবে এবং সংযোগ স্থাপন করতে হবে।”

মওসুম-ও যখন বিবেচ্য
বছরের কোন সময় ব্যবসা শুরু করছেন, সেই সঠিক সময়টা বেছে নেওয়ার ক্ষমতা-অক্ষমতা আপনার ব্যবসাকে প্রভাবিত করতে পারে। ‘নতুন বছরে নতুন কিছু’ বিশ্বাসের কারণে কিছু লোক বছরের শুরুতে ব্যবসা শুরু করতে পারেন। কিন্তু, আসল বিবেচনা হওয়া উচিত যে, কখন পণ্যটি বাজারে নিয়ে গেলে তা ভোক্তারা সহজে গ্রহণ করবেন। একটি ব্যবসা তখনই প্রতিষ্ঠা করা উচিত যখন বাজার তা গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত।

আপনি যদি পোশাক দিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু করতে চান, তাহলে বছরের শুরু বা শেষ নয়; বরং উৎসবের সময়টা আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ সময়। আপনি যদি পর্যটন সম্পর্কিত কোন উদ্যোগ নিতে চান, তাহলে অবশ্যই তা হতে হবে শীতের সময় যখন মানুষ বেড়াতে যান। আপনি যদি মওসুমি ফলের সরবরাহ দিতে চান, তাহলে কেনো তা গ্রীষ্মে হবে না যখন বাংলাদেশে মওসুমি ফল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। তবে, আপনি কোন বাজারকে টার্গেট করবেন সেই বিবেচনাও আপনার থাকতে হবে।

সুতরাং আপনি এখন প্রস্তুত
আপনার ক্ষেত্র যাই হোক না কেন, একটি ব্যবসা চালু করার সর্বোত্তম উপায় হলো একটি শক্তিশালী এবং কৌশলগত ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করা। তবে, এটি বাস্তববাদী হয়ে কার্যকর করা এবং টিকিয়ে রাখার উদ্ভাবনী ক্ষমতাও আপনার থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: একটি ব্যবসা চালানোর জন্য আপনার ইপ্সিত ভোক্তা, আপনার শিল্প সম্পর্কিত অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, কর আইন সম্পর্কিত বিষয়-আশয় এবং আপনার নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতা সম্পর্কে নিজের পূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকতে হবে।

একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক পরিকল্পনা এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজার বিশ্লেষণ আপনা র দৃষ্টিকে শক্তিশালী করতে পারে যা আপনার ধারণাকে বাস্তবে রূপান্তর করতে সাহায্য করবে। একইসঙ্গে আপনি বুঝতে পারবেন যে, নতুন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য কোনটি আপনার কাছে সবচেয়ে সঠিক সময়।

ডেস্ক রিপোর্ট,
উদ্যোক্তা বার্তা

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here