বিএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাইড ফিজিক্স এ ভর্তি হন মোঃ লুৎফুর রহমান। সংসারের বড় ছেলে হওয়ায় চাকরির প্রয়োজন খুব বড় হয়েইফ দাঁড়ায়। বাবার ছিলো পাটের ব্যবসা। বাবার ব্যবসার সাথে কোন প্রকার সম্পর্ক না থাকলেও লুৎফুর রহমান বিটিএমসি’র একটি সরকারি জুট মিলের বিপনণ বিভাগে চাকরি নেন। লেখাপড়াও ছিলো চাকরির পাশাপাশি। চাকরি এবং পড়াশোনা দুটোর সময় মিলাতে না পারায় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা খান্ত দিলেন লুৎফর। ১৩ বছর চাকরি করলেন। এরই মাঝে মিল হয়ে গেলো বেসরকারি। চাকরির সুবাদে অভিজ্ঞতা হলো পাটজাত পণ্য রপ্তানির। চিন্তা করলেন এই অভিজ্ঞতাকেই পুঁজি করে নেমে পড়বেন ব্যবসায়। চাকরি ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন লুৎফুর রহমান।
আশির দশকের শেষ, মূলধন হলো একটি লাইসেন্স, যোগাযোগের জন্য একটি টেলিফোন। ৮৮ থেকে ৯৫ সাল, বিভিন্ন জুট মিল থেকে পণ্য ফিনিশড ব্যাগ ক্রয় করে তার সাথে মার্জিন যোগ করে বিক্রয় করলেন। পাটকলের বড় বাবু হয়ে চাকরি করা বড় মানুষটি যখন একজন উদ্যোক্তা হয়ে নিজে কিছু করবেন ভেবে পথে নামলেন তখন পথটা খুব সোজা ছিলো না। মিলের দাড়ে দাড়ে ঘুরতে থাকলেন। ১৫-২০ টি মিলে নিয়মিত যেতে থাকলেন উদ্যোক্তা কিন্তু সুযোগ মিলে না। ৪-৫ টি মিলে সাড়া মিললো পূর্ববর্তী চাকরির সুবাদে। যোগাযোগা হলো জুটইয়ার্ন এবং জুটের ব্যাগ এই দুটি পণ্য বিক্রয় করেই উদ্যোক্তা প্রথম ৫ বছরে ৭ লক্ষ টাকা লাভ করলেন।
ইরান, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, রাশিয়া এবং শ্রীলংকায় ভালো বায়ার ছিলো। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় যন্ত্রপাতির প্রতি এবং নতুন নতুন আবিষ্কারের প্রতি ঝোঁক ছিলো প্রবল। ব্যবসা করতে গিয়ে কোরিয়ান বায়ারের সাথে পরিচয়। সেখান থেকেই জানলেন, হাতে-কলমে শিখলেন নার্সারি আইটেমের কথা।
সানারপারে প্রথম ফ্যাক্টরি। নিজস্ব কারখানায় জুট নার্সারি টেপ, জুট নার্সারি সীট, জুট নার্সারি রোপ এই তিন আইটেমের উৎপাদন শুরু করলেন উদ্যোক্তা লুৎফুর রহমান। বিদেশ থেকে সাড়া মিললো ব্যাপক। শীতপ্রধান দেশে গাছের চারা, নার্সারি চারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে নিতে ব্যবহৃত হয় নার্সারি সীট। ভীষণ সাড়া পেলেন উদ্যোক্তা এই নার্সারি সীটের। বছরে ২০ লক্ষ টাকার সীট রপ্তানি করতে শুরু করলেন উদ্যোক্তা। শীত প্রধান দেশে বরফ থেকে গাছকে রক্ষা করবার জন্য ব্যবহৃত হয় নার্সারি টেপ। কোরিয়া বড় বায়ার হয়ে দেখে দিলো। জাপান আর ফ্রান্স থেকেও সাড়া মিললো প্রচুর। নার্সারি রোপ গাছের সোজা হয়ে বেড়ে উঠবার জন্য এ সকল কাজগুলোর জন্য ভীষণ জরুরি একটি পণ্য। প্রধান বাজার কোরিয়া। তিনটি পণ্যে উদ্যোক্তার জীবন ধরা দিলো সফলতা। ট্রেডিং ব্যবসার পাশাপাশি উৎপাদন চলতে থাকে।
লুৎফর রহমান বলেন, মূলধন ছাড়া ব্যবসা শুরু এবং কঠোর পরিশ্রম এই দুটোই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে যে আমি কিভাবে একজন সফল উদ্যোক্তা হতে পারি। ক্ষুদ্র হোক, মাঝারি হোক একটা পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে যেতে পারি। তাই আমি আমার কর্মপ্রচেষ্টা, সততা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এখন যে জায়গায় চলে এসেছি পেছনের সেই জায়গাটাকেও আমি মূল্যায়ন করি। কারণ সেই জায়গাটা না থাকলে আমি হয়তো আজ সফল উদ্যোক্তা হতে পারতাম না।
তিনি বলেন, ২০০৭ সালে নতুন ট্রেডিং কোম্পানি সাজু ইন্টারন্যাশনালের লাইসেন্স করি। জুটের তৈরি কফিবিন ব্যাগ, ক্রিসমাস ব্যাগ, নার্সারি পট ইত্যাদি নতুন পণ্যের নতুন বাজার পাপোয়া নিউগিনি, ইউরোপ এবং জাপান। জুট ফেব্রিক থেকে লেডিস ব্যাগ, জেন্টস ব্যাগ, হ্যান্ড পার্স, হাউস হোল্ড আইটেম, টিস্যু বক্স, পেন্সিল বক্স, জুয়েলারি বক্স, টিফিন বক্স, গিফট আইটেম আমাকে নিয়ে গেলো সফলতার এক অনন্য উচ্চতায়।
নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি দড়ি উৎপাদন শুরু করলেন উদ্যোক্তা যার বায়ার কোরিয়া। নিত্যনতুন গবেষণা চলছে উদ্যোক্তার ফ্যাক্টরিতে তার কর্মে। প্রায় ২০ জন কর্মী নিয়ে উদ্যোক্তা বছরে ২ কোটি টাকার উপরে পণ্য রপ্তানি করতে থাকেন। ২০১৬ সালে জাতীয় এসএমই বর্ষসেরা মাইক্রো উদ্যোক্তা হলেন লুৎফুর রহমান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে উদ্যোক্তা বলেন, আমার রপ্তানির পাশাপাশি নার্সারি আইটেম এবং ট্রেডিশনাল জুট পণ্যের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারে কিছু ভ্যারাইটি শপিং ফেন্সি ব্যাগ এবং লেডিস আইটেম, জেন্টস আইটেম স্পোর্টস ব্যাগ এই ধরণের কিছু শুধুমাত্র পাটের একক পণ্য দিয়ে উপস্থাপন করার পরিকল্পনা আছে। সম্প্রতি বিদেশী ক্রেতা চাহিদা অনুযায়ী জুট স্টিক পার্টিকেল করার একটা উদ্যোগ নিয়েছি। এবং আশা করি যে ভবিষতে হয়তো জুট স্টিক পার্টিকেল বড় আকারে একটা সীট প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা