মায়ের পেটে যখন ছিলেন তখন তবলা বা গানের আওয়াজ শুনলেই নাকি খুব নড়াচড়া করতো। তাই সাংস্কৃতিমনা বাবার প্রচন্ড ইচ্ছে মেয়ে হলে ওকে অবশ্যই নাচের শিল্পী বানাবে। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মেয়েই হলেন। সাড়ে ৩ বছর বয়সে প্রথম স্টেজ প্রোগাম করে খুব নামও কুড়ালেন আর সেই থেকে শুরু হল আকসা ইসাডোরা হৈম’র নাচের যাত্রা।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/uddoktabarta00.jpg)
১৯৮৯ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বহু জাতীয় পুরস্কার অর্জন করলেও ধর্মীয় অনুশাসনে নামের শেষে নৃত্যশিল্পী টা মুছে ফেলতে হয়। এভাবেই কেটে যায় কয়েকটি বছর এর মাঝে বিয়ে, সন্তান। ২০১৪ সাল হৈমর জীবনের এখন পর্যন্ত সব থেকে অন্ধকার অধ্যায়। মা মারা যান, অবিবাহিতা বোন যার সকল দায়িত্ব তার উপর, সাথে নিজের বাচ্চাটার বয়স সাড়ে ৩ বছর।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/WhatsApp-Image-2020-03-23-at-5.36.49-PM-1.jpeg)
হৈম নেশায় নৃত্যশিল্পী হলেও পেশায় একজন পুষ্টিবিদ এবং তখন তিনি খুলনার একটা মেডিকেল হসপিটালে পুষ্টিবিদ হিসেবে ছিলেন। আর তার মা মারা গিয়েছিলেন ওই হসপিটালেই। ক্যান্সারে মারা যাওয়া মায়ের স্মৃতি গুলো নিয়ে ওই হসপিটালে চাকরি টা করতে আর পারছিলেন না। ছেড়ে দিলেন চাকরিটা।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/WhatsApp-Image-2020-03-23-at-5.36.48-PM-1.jpeg)
এরপর কি করবে, কোথায় যাবে ঠিক কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। হৈম বেশ আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলেন, “আমরা দুটা বোন হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম পৃথিবীটা যেমন দেখে এসেছি, তেমন না। যতটা কঠিন ভেবেছি, তার থেকেও অনেক কঠিন। বসে থাকলে হবে না আমার। প্রথমেই দায়িত্ব এসে পড়ল বোনটা কে বিয়ে দিতে হবে। ওকে বিয়ে দিলাম। এর পর আমার বীভৎস একাকীত্ব আর হতাশার সময় শুরু হলো”।
ছোটবেলা থেকেই মুক্তিযোদ্ধা বাবা আর স্কুল শিক্ষিকা মা সাবলম্বী হতে শিখিয়েছিলেন, তাই বসে না থেকে ডাক্তার এক ছোট ভাইয়ের সহযোগিতা, বুদ্ধি আর স্বামীর চেষ্টায় শুরু করলেন নিজস্ব চেম্বার ‘Health and nutrition care’। কিছুটা ব্যাস্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু ছোট বোন ইসাবেলা ঐশী তারই মত হতাশায় ডুবে ছিল।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/WhatsApp-Image-2020-03-23-at-5.36.47-PM-1024x682.jpeg)
উদ্যোক্তা হৈম বলেন, “আমার আরও এক কাজিন নওশীন জামান খুলনার চারুকলা থেকে অসম্ভব ভালো রেজাল্ট করেছে। তখন ওর অবসর তাই নিজের ঘর সাজিয়ে ফেললো নিজের হাতের অসম্ভব সুন্দর সুন্দর পেইন্ট করে আর তেমন কিছু করতে না পারায় নিজের কনফিডেন্স লেভেল টা শূন্যের কোঠায় নিয়ে বসে ছিল। দেখলাম সংসারের কাজের ভিড়ে আমরা নিজেদের নামটাকেই হারিয়ে ফেলছিলাম হঠাৎ করে একটা ডিসিশন নিলাম আমরা ৩জন মিলে অনলাইনে বিজনেস শুরু করবো”।
২০১৬ সালে লেডিস ওয়্যার নিয়ে শুরু হলো ‘ফেব্রিকার্ট’ এর যাত্রা। নওশীন আর ঐশী ঢাকায় থাকায় তাদের দায়িত্ব পড়লো কাঁচা মাল কেনা থেকে শুরু করে প্রোডাক্ট রেডি করা আর যেহেতু হৈম খুলনায় থাকত তাই তার কাজ হল খুলনায় প্রোডাক্ট গুলো সেল করা। একটু একটু করে মানুষকে কনভিন্স করিয়ে বোঝানো যে, তাদের প্রোডাক্ট গুলো কোয়ালিটি ফুল এবং লুকরেটিভ।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/WhatsApp-Image-2020-03-23-at-5.36.50-PM-1024x680.jpeg)
মাত্র ১৫হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা প্রথম লটের প্রোডাক্ট খুব দ্রুত সেল হয়ে গেল, কিন্তু সেটা শুধু অফলাইনে। পেজটা তৈরি হলেও তেমন কোনো সাড়া ছিল না প্রথম ১বছর। কারণ তখন মানুষও তেমন অভস্ত্য ছিল না অনলাইনে কেনাকাটা সম্পর্কে যেন ভরসাই পেত না। কাস্টমার যা ছিল শুধু অফলাইনে পরিচিত মানুষ আর আত্মীয়স্বজন।
উদ্যোক্তা আকসা ইসাডোরা হৈম বলেন, “অনেক উপহাসের সম্মুখীন হতে হয়েছে যে পুষ্টিবিদ হয়ে বা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সেই যদি কাপড় বিক্রি করি তাহলে এত কষ্ট করে পড়াশুনা করলাম কেন? ঝোলা হাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় সেল করেছি। ভেঙে পড়লাম না, কেমন একটা জেদ ভর করল। আমার বোনেরা খুব হতাশায় পরে গেল, আর আমার কাজ ছিল শুধু ওদের উৎসাহ দেয়া আর কাজ করার তাড়া দেয়া”।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/WhatsApp-Image-2020-03-23-at-5.36.48-PM.jpeg)
হঠাৎই একটা অর্ডার, সঠিকভাবে পণ্য ডেলিভারি দেয়া হলো। এবং আস্তে আস্তে খুব ভালো সাড়া মিলতে লাগলো। আর তখনই ২য় সিদ্ধান্ত, ২০১৮ তে খুলনার প্রাণকেন্দ্রে নিজস্ব শোরুম। কোনো রকম ব্যাংক লোন ছাড়া শুধু মাত্র মনের জোড় আর হাসবেন্ডদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১২০০ স্কয়ার ফিটের একটা শোরুম হলো। ফেব্রিকার্ট আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো। ক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকায় নিয়োগ দেয়া হয় হাতের কাজ ও টেইলারিং কর্মীদের। পণ্য থেকে যে লভ্যাংশ আসতো তা পুনরায় বিনিয়োগ করত উদ্যোগের প্রসারের জন্য। এভাবেই তাদের ব্যবসায়িক মূলধন বেড়ে যা বর্তমানে ৫০ লাখের মত।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/WhatsApp-Image-2020-03-23-at-5.36.49-PM.jpeg)
ঠিক এই সময় আরো একজন যোগ দিলেন, নুসরাত জামান। তিনিও একজন ডিজাইনার এবং উদ্যোক্তা হৈমর এক কাজিন। যার পরিশ্রম আর বুদ্ধির কারণে বিক্রয় এবং পরিচিতি বহুগুণে বেড়ে গেলো। মূলত হ্যান্ডপেইন্ট, সুতারকাজ, নকশিকাজ, ব্লক, বাটিক, এমব্রয়ডারি, নারীদের শাড়ী, থ্রীপিস ও পুরুষদের পাঞ্জাবি, ফতুয়া, তাদের সিগনেচার আইটেম, ক্যানভাস শাড়ী ও কাপল ড্রেস ক্রেতাদের মন জয় করে। ২০১৯ সালে তারা সিরাজগঞ্জে একটি পুরাতন তাঁতবাড়ি সংস্করণ করেন এবং ৫ জন তাঁতির কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। বর্তমানে তারা তাদের নিজস্ব ডিজাইনের তাঁতের শাড়ী ও ওড়না তৈরি করে থাকেন।
![](https://uddoktabarta.com/wp-content/uploads/2020/03/WhatsApp-Image-2020-03-24-at-8.06.57-PM-1024x682.jpeg)
বতর্মানে তাদের মোট কর্মীর সংখ্যা সব মিলিয়ে ২৫ জনের মত। উদ্যোক্তা আকসা ইসাডোরা হৈম বলেন, “আসলে সব কথা বলে শেষ করা যাবে না, তাই শুধু শেষে একটা কথাই বলবো আমাদের মত বিবাহিত মেয়েদের সংসারের বাইরে কিছু করা মানেই অনেক কষ্ট করতে হয়, কাঠ খড় পোড়াতে হয়, অনেক যুদ্ধ করতে হয়। আর এইসব করে সফলতা তখনই আসে যখন মনের অসম্ভব জোড়, ধৈর্য্য ও স্বপ্ন থাকে”।
তিনি আরও বলেন, “ঘুমিয়ে থেকে স্বপ্ন তো সবাই দেখে, সার্থক তো তখনই হয় যখন কেউ জেগে থেকে স্বপ্ন দেখে আর তা পূরণ করার জন্যে পূর্ণ মনের জোড়ে স্বপ্নের পথে হাঁটতে থাকে। আমি হাঁটছি সে পথে কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে বাঁকিটা আপনাদের দোয়া”।
বিপ্লব আহসান