উদ্যোক্তা ডেভ ফার্গুসন বামে এবং ডানে জিয়াজুন ঝু

মানুষের সভ্যতা এগিয়েছে চাকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছনোর তাগিদ থেকে মানুষ আবিষ্কার করেছে একের পর এক যাতায়াতের মাধ্যম। আরও আরামদায়ক আর দ্রুতগামী হওয়ার প্রয়োজনীয়তায় দিনে দিনে উন্নত হয়েছে যানবাহন। সে আপনার ভারী সামগ্রী নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার তাগিদ হোক কিংবা আপনি সবান্ধবে বেড়িয়ে আসবেন বলে, তাই প্রযুক্তিবিদেরা তৈরি করেছেন একটির থেকে আরও ভালো আরেকটি যানবাহন।

কখনও রথে চড়েছে মানুষ, কখনও একা গাড়িতে, বাষ্পে চলা রেল গাড়ি আর আকাশে ওড়ার উড়োজাহাজ। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসটা যোগাযোগ ব্যবস্থার বিবর্তন দিয়েই স্পষ্ট বোঝা যায়। আর আজ মানুষ স্বপ্ন দেখছে হাইপার লুপে চড়ার।

কিন্তু মজার কথা হল যত সে গাড়ি চড়েছে তত সে উপলব্ধি করেছে গাড়ি চালানোয় মজা নেই। এটা প্রোডাক্টিভ কাজ নয়। অত্যন্ত মনঃসংযোগ প্রয়োজন পড়ে। যন্ত্রের মত নির্ভুল হতে হয়। নির্দিষ্ট যুক্তি মেনে চলতে হয়। আর মানুষ আবেগ নির্ভর প্রাণী। যত তার ব্যস্ততা বাড়ছে, ততই সে ক্রমশ রিস্ক সোসাইটির ভেতর প্রবেশ করছে। ততই তার মনের কোণে ক্লান্তি বিষণ্ণতা আর অহংবোধের আবেগ। যা তাকে বিপন্ন করে তুলছে প্রতিনিয়ত। ফলে গাড়ি চালানোর মুহূর্তে সব থেকে বেশি আবেগ মাথার বেতর ঘুড়পাক খায়। মাথার ভেতর আনাগোনা করে তার ব্যক্তিগত জীবনের আবেগ নয়তো তার কর্মজীবনের উদ্বেগ। কিন্তু গাড়ি চালানোর মুহূর্তে অন্য কোনও কথা ভাবা যদিও মানা। কিন্তু সব থেকে ভাবনা ঘিরে ধরে ওই নীরব সময়টাতেই।

আর এখানেই সমস্যার গন্ধ পেয়েছে গুগল থেকে শুরু করে বিশ্বের তাবড় টেকনোলজি সংস্থা। তৈরি হয়েছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রয়োগে তৈরি হয়েছে এমন সাইকেল যাতে চড়ে বসলে সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ার ভয় তো থাকবেই না বরং চালাতেও হবে না। সে চলবে নিজস্ব ছন্দে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে ভর করে। রাস্তার সিগনাল মেনে, নিয়ম মেনে। আপনি শুধু বসে থাকবেন আর নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। এরকম মালবাহী গাড়িরও পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে। উবার ব্যবহার করেছে এই ধরণের মালবাহী যান। এবার এরকমই একটি প্রয়োগ হল সম্প্রতি। রীতিমত চালু হয়ে গেল ক্যালিফোর্নিয়ায়। কিন্তু বিশাল ট্রাক বা মালবাহী বড় গাড়ি নয়। এ শুধু মফস্বলের রাস্তার জন্য তৈরি হওয়া একটি মাঝারি মাপের চলমান কেবিন।

এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় জিনিসপত্র নিয়ে যেতে গেলে মানুষের স্বাভাবিক সহজাত আলসেমিগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়ার যন্ত্র। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার পরিসেবা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতেও সুবিধা হবে, এমন যান চালু হল সম্প্রতি।

এসেছে ন্যুরো’র (Nuro) চালক বিহীন গাড়ি। চালক বিহীন এই চার চাকার লঞ্চ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়াবাসীর। দেখতে মনে হবে চাকার ওপর বিরাট কেবিন, অনেকটা রোবটের মতো। ন্যুরো নামে একটি স্টার্টআপই চালকবিহীন এই গাড়ি তৈরি করেছে। উদ্দেশ্য হল পিৎজা, মুদি-মাল অথবা লন্ড্রির কাপড় চোপড় ঠিক ঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। অনেক সময় আমরা অনলাইনে কেনাকাটা করি। বাইকে অথবা গাড়িতে করে সেইসব জিনিসপত্র ডেলিভারির জন্য হয়ত আর মানুষের প্রয়োজন পড়বে না। চাকার ওপর কেবিন ডিজাইন করার সময় স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিকেলসর উচ্চতা মাথায় রাখা হয়েছে। অবশ্য প্রস্থের দিকে ন্যুরো অনেক বেশি উপযোগী। বৈদ্যুতিক এই গাড়ির ভেতর চারটি আলাদা কামরা রয়েছে। রেফ্রিজারেটর, কুকিং অথবা স্টোরেজ সবকিছুর জন্য আলাদা কামরা ব্যবহার করা যেতে পারে। সাধারণ গাড়ির এক তৃতীয়াংশ ওজন এই বাহনের আরেকটা সুবিধা। এই গাড়ি সহজে মফস্বল এবং শহরতলীর নানা রাস্তায় নিশ্চিন্তে চললেও হাইওয়েতে একদম মানা।

উদ্যোক্তা ডেভ ফার্গুসন এবং জিয়াজুন ঝু দুজনেই ন্যুরো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কো-ফাউন্ডাররা ২০১৬ সালে গুগলস সেলফ ড্রাইভিং কার প্রোগ্রামের মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেন। মন দেন নিজেদের স্বপ্ন সফল করার কাজে। ক্যালিফোর্নিয়ায় ন্যুরো চালুর আগে আইনী জটে নানা সমস্যা তৈরি হয়। কারণ টেস্ট ড্রাইভ ছাড়া কোনও গাড়ি চলার অনুমতি দেওয়া হয় না এখানে। আশার আলো একটাই ন্যুরো সওয়ারিবিহীন। ফলে চালকহীন এই রোবট গাড়ির অনুমতি মেলার আলোর রেখা এখনও মিলিয়ে যায়নি। তাছাড়া আকারের সুবিধার জন্য ন্যুরো সহজে রাস্তা এবং পথচারীদের বুঝে নিতে পারে। তেমন পরিস্থিতি তৈরি হলে পথচারীকে বাঁচিয়ে আশপাশের কোনও গাছে ধাক্কা মেরে সামাল দিতে পারে। যদিও কোনও পথচারী বা রাস্তা ব্যবহারকারী কোনওভাবে ন্যুরো এর সংস্পর্শে আসার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না কারণ যানটির গতিবিধি আগেভাগে গায়ে লাগানো পর্দায় ভেসে ওঠে।

কো-ফাউন্ডার ফার্গুসন জানাচ্ছেন, কোনওরকম ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে অন্য গাড়ির চালকদের ন্যুরো তার পরবর্তী মুভমেন্ট জানিয়ে দেয়। কিন্তু বাড়তে থাকা জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যন্ত্র যদি কাজ কেড়ে নেয় তাহলে বিষয়টা উদ্বেগের। উদ্যোক্তা ফার্গুসন অবশ্য তা মানতে নারাজ। তার মতে- উল্টো বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে ন্যুরো। যেদিকে এগোচ্ছে একদিন হয়ত দেখা যাবে বাড়ি বাড়ি জিনিসপত্রের ডেলিভারি দিতে রাস্তার দখল নেবে ন্যুরোই। খুব একটা মন্দ হবে না তাহলে।

এটি মূলত একটি সীমাবদ্ধ পরীক্ষা, তবে চালকবিহীন ভবিষ্যতের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। নুরো দু’জন প্রাক্তন গুগল ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং জাপানি সংস্থা সফটব্যাঙ্ক’র বিনিয়োগ রয়েছে এটি তৈরিতে।

(তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট থেকে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here