কাঠ-বাঁশ-ক্লে দিয়ে গহনায় সফলতা

0
উদ্যোক্তা মৌ মাহজাবীন

ছয় বছর এনজিওতে জব করে ২০১৭ সালে চাকরিকে বিদায় জানান মৌ। চাকরীর ধরা-বাঁধা সময় এবং কাজে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। নিজ উদ্যোগে নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে কাজ করার ইচ্ছা থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মৌ মাহজাবীন।

এক বছর পরিকল্পনা করে ২০১৮ সালে মাত্র দুই হাজার টাকা মূলধন নিয়ে উদ্যোগের শুরু। শুরুটা ছিল ক্লোদিং আইটেম নিয়ে। ব্লক-বাটিক, টাই-ডাই, ড্রেস, শাড়ি, বেডশিট সবকিছুই রাখার পরিকল্পনা ছিল। এজন্য বাংলাদেশ টেকনিক্যাল শিক্ষা বোর্ড থেকে ব্লক-বাটিকের উপর ছয় মাসের প্রশিক্ষণও নেন। ২০১৮ সালে ১৪ এপ্রিল (১লা বৈশাখ) ‘জয়ীতা কালেকশন’ নামে একটি অনলাইন বিজনেস পেজ চালু করেন। ক্লোদিং এর পাশাপাশি গহনাও ছিল তার উদ্যোগে।

পুরো ২০১৮ সাল বৈশাখ-ফাল্গুন-একুশে ফেব্রুয়ারিসহ বিশেষ দিনগুলোতে ড্রেস, শাড়ি ও গহনা নিয়ে সমানতালে কাজ চলছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে ঘুরতে পর্যালোচনা করে দেখলেন ক্লোদিং নিয়ে কাজ করতে হলে হেল্পিং হ্যান্ড লাগে, যা তার ছিল না।

তাই ২০১৯ সালের প্রথম দিকে ক্লোদিং আইটেমের পাশাপাশি গহনার কাজকে সামনে তুলে আনার জন্য বেশি করে কাজ শুরু করেন। শুরু হয় ‘সমীকরণ ক্রাফটস’ এর যাত্রা। বেষ্ট কোয়ালিটির প্রোডাক্টের প্রায়োরিটি বেশি হওয়ায় নিজে গহনা বানানোর কাজ শুরু করেন। সে সময় তিনি কাঠের গহনা, মেটালের গহনা, ঝিনুকের গহনা, গামছার গহনা তৈরি করতেন। কাজের মধ্যে তিনি বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টও করছিলেন। ২০২০ সালে ‘সমীকরণ’ বাঁশ-এর গহনা নিয়ে হাজির হয়। বাঁশ দিয়ে ঘরের সাজসজ্জা-আসবাবপত্র সবাই দেখেছেন; কিন্তু নগর জীবনে বাঁশের তৈরি গহনা প্রথম ‘সমীকরণ’ থেকেই এসেছে বলে জানালেন মৌ। বাঁশের মালা, দুল, আংটি, খোঁপার কাটায় প্রাকৃতিক দৃশ্যপট হ্যান্ডপেইন্ট করেছেন তিনি।

এছাড়াও জুটের গহনার কাজে সম্পূর্ণ ফিউশন আর এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে শুরু করেন যা সবার কাছে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০২১ সাল থেকে কাজের পরিধিকে আরেকটু বিস্তার করতে শুরু করেন প্রাকৃতিক পাথর আর মুক্তার কাজ। আমাদের দেশে যেহেতু মুক্তা বা প্রাকৃতিক পাথরের ম্যাটেরিয়ালস হাতে বানানো হয় না, তাই গহনা বানানোর উপকরণগুলো বাইরে থেকে এনে সেগুলো দিয়ে এক্সক্লুসিভ গহনা তৈরি করেন মৌ। সময়ের সাথে সাথে কাজের ধরন, প্যাটার্ন, ডিজাইন প্রতিমূহূর্তে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন হতেই থাকে তার।

পণ্য তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ, পণ্যের গুণগত মান যাচাই, নিজস্ব ডিজাইনে পণ্য তৈরি, পণ্যের ফটোগ্রাফি, ফেসবুকে পোস্ট, কাস্টমারের সাথে যোগাযোগ, পণ্যের প্যাকেজিং এবং কাস্টমারের কাছে ডেলিভারি দেওয়াসহ সব কাজ তিনি নিজেই করেছেন। এখন শুধু একজন সহযোগী আছেন।

পাটের গহনাও রয়েছে তার, যা দেশীয় এবং রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে। পাটকে রিফাইন করে ভিন্ন ভিন্ন নতুন নতুন ডিজাইন তোলা হয় গহনায়। ‘সমীকরণ’ চেষ্টা করে সবসময় নতুনত্ব এবং সৃজনশীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে। সেজন্যই সিগনেচার পণ্য হিসেবে পরিবেশবান্ধব বাঁশ দিয়ে ভিন্ন প্যাটার্নে কাজ শুরু করেন।

পাশাপাশি ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা কাঠের গায়ে ফুটিয়ে তৈরি করা হচ্ছে রকমারি গহনা। কাঠের গহনার ডিজাইনগুলো মূলত কম্পিউটারাইজড নকশা করে, সেই অনুযায়ী কাটিং হয় সি এন সি মেশিন কিংবা লেজার বিম দিয়ে ডিজাইনগুলোকে নকশায় তোলা হয়। এরপর টুকরো ডিজাইনগুলোকে কখনও আঠা দিয়ে বসানো হয়, আবার কখনও রংতুলি দিয়ে পরিপূর্ণতা দিয়ে সাজানো হয় গহনা।

‘সমীকরণ’-এ অলংকার হিসেবে শুধু কাঠ-বাঁশে সীমাবদ্ধ নয়, নিয়ে এসেছে নতুন কালেকশন ক্লে, যা বেশ জনপ্রিয় এখন পুরো দেশজুড়ে। ক্লে গহনাতে বেশিরভাগ ফুটে এসেছে রজনীগন্ধা, কাঠগোলাপ, কৃষ্ণচূড়া, জবা, শিউলি, নয়নতারা, পলাশফুল, পদ্ম, অপরাজিতাসহ ভিন্ন ভিন্ন ফুলের মোটিফ।

যে কোন দেশীয় উৎসবের দিনগুলো রাঙাতে প্রতিবারই ‘সমীকরণ’ নতুন করে ভাবে। নিত্যনতুন কাঁচামাল দিয়ে চলে নতুন ভাবনাচিন্তা।

ঢাকা মিরপুর থেকে পুরান ঢাকা, খিলগাঁও, খিলখেত, উত্তরা, বাসাবো, মগবাজার, গুলশান, বাড্ডা, বনানী, বসুন্ধরাসহরাজধানীর সব জায়গায় যেমন ‘সমীকরণ’-এর গহনা ছড়িয়েছে, তেমনি যাচ্ছে ঢাকার বাইরে দেশের ৬৪ জেলাতেই। এমনকি আমেরিকা, কানাডা, ওমান, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারতেও গিয়েছে মৌ’র গহনা।

কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটির দিকে বেশি ফোকাস দিয়ে কাজ করেন মৌ। মাসে ১০-১৫টার বেশি গহনার কালেকশন না রাখার চেষ্টা করেন। তার কাছে কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার গহনার চাহিদা সারাবছর জুড়েই থাকে, তবে ঈদ-পূজা-পার্বণে চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। গড়ে মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হয় ‘সমীকরণ’-এর পণ্য।

উদ্যোক্তা মৌ মাহজাবীন বলেন: আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছোট্ট একটি বুটিকস শো-রুম। সেখানে ‘সমীকরণ’-এর নিজস্ব ডিজাইনের ড্রেস, শাড়ি, কুর্তিসহ এক্সক্লুসিভ পার্ল-পাথরের পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের বাহারী গহনার কালেকশন থাকবে। কিছু লোক রেখে বুটিকস আর গহনার কাজগুলোকে আরও দ্রুততার সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এতে কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হবে।

সেরা উদ্যোক্তা হিসেবে ২০১৯ সালে Women and e-Commerce Trust (WE) প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘বেস্ট ইন ক্রাফটস’ পুরস্কার অর্জন করেন মৌ মাহজাবীন। তিনি ইডেন কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে মিরপুর থেকে অনলাইনে বিজনেস পরিচালনা করছেন। নিজের পণ্যের ডেলিভারি প্রথম তিন বছর তিনি নিজেই ডেলিভারি দিয়েছেন। বর্তমানে এ কাজে তার একজন সহযোগী রয়েছেন৷

সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here