উদ্যোক্তা- খুরশিদা জাহান

মায়ের কাছ থেকে রান্নায় হাতেখড়ি, তারপর শাশুড়ির থেকে অবাধ স্বাধীনতা, পাশাপাশি পেয়েছেন স্বামী সন্তানদের সহযোগিতা, আর তাতেই রান্নায় বাজিমাত করেছেন উদ্যোক্তা খুরশিদা জাহান।

সৃষ্টিশীল মানুষরা কখনো ঘরে বসে থাকতে পারেন না, এর প্রমাণ খুরশিদা। লাভিশ ডিজাইন নামের বুটিকসের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে জনপ্রিয়তা পাওয়া উদ্যোক্তা করোনাকালে শুরু করলেন খাবারের ব্যবসা।

দীর্ঘ ২৩ বছরের সংসার জীবনে হরেক রকমের সুস্বাদু খাবার পরিবার, বন্ধু- বান্ধবের মাঝে পরিবেশনের পর এই মহামারিতে নিজের রান্নার সৃজনশীলতা দিয়ে মাস দুয়েক আগে যাত্রা শুরু করল ‘ঘরের খাবার’। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে ও স্বামীর সহযোগিতায় খুরশিদার ঘরের খাবারের গল্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঠিক যেন ‘হট কেক’।

করোনাকালীন সময়ে খাবারের ব্যবসায় জড়ালেন কেন জানতে চাইলে ‘ঘরের খাবার’ এর স্বত্বাধিকারী খুরশিদা জাহান উদ্যোক্তা বার্তাকে বলেন, ‘ইচ্ছাটা আগে থেকেই ছিল। বুটিকস ব্যবসার পাশাপাশি ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর একটা ইচ্ছা ছিল। খাবার বিষয়টাতে আগ্রহ থাকা, যে কোন পারিবারিক আয়োজনে, বন্ধুদের আমন্ত্রণে বাসায় রান্না করা হতো, পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে রান্নার স্বাদের প্রশংসাটাও খুব পেতাম। তাই এই মহামারিতে অবসর ছিলাম, মূলত সেটাকে কাজে লাগিয়ে শুরু করি অনলাইনে খাবারের ব্যবসা’।

খাবারের ব্যবসার চিন্তাটা কীভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘অনেক আগে আমার মামী শাশুড়ি আমাকে প্রথম খাবারের ব্যবসার আইডিয়াটা দেন, যদিও তখন আমি বুটিকসের ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত। বিষয়টা সেসময় মাথায় ঢুকে থাকলেও আমাকে আলোড়িত করতে পারে নি। করোনাকালে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই’’।

‘ঘরের খাবার’ এর বিশেষ্যত্ব কী? অনলাইনে দীর্ঘদিন ঘরে অনেকে এমন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, গ্রাহক কেন আপনার খাবার অর্ডার করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে খুরশিদার সোজাসাপটা উত্তর: ‘‘আমি কিন্তু খাবারের সব আইটেম নিয়ে ব্যবসায় জড়াই নাই, আমি যে খাবারগুলোতে স্বাদের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত সেসব খাবারগুলোই গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। এটাই আমার বিশেষ্যত্ব’’।

খুরশিদা জানালেন, ঘরের খাবারের প্রধান আকর্ষণ দইবড়া। তার বানানো দইবড়া সবাই পছন্দ করে, এ বিষয়ে তিনি শতভাগ নিশ্চিত তাই গ্রাহকদের জন্য দইবড়াটা প্রধান হিসেবে রেখেছেন।

‘নিয়মিত আইটেম গুলোর মধ্যে রয়েছে তেহারি, প্লেইন পোলাও, রোস্ট, বিফ রেজালা, টিকা, ডিমের কোরমা সহ মাছের কিছু আইটেম, যার মধ্যে যে কোন ধরণের মাছ ভুনা, সর্ষে ইলিশ অন্যতম।’

‘এছাড়াও কয়েকটি চাইনিজ আইটেমও করে থাকেন খুরশিদা। সেগুলো হলো ফ্রাইড রাইস, চাইনিজ ভেজিটেবলস, চিকেন চিলি ও চিকেন ফ্রাই।’

খাবারের ব্যবসায় প্রথমত কোন জিনিসটা বেশি খেয়াল রাখা প্রয়োজন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খাবারের ব্যবসায় বেশ কিছু জিনিস মাথায় রাখতে হবে। আমি নিজে ঝাল পছন্দ করলেও যখন খাবারের অর্ডার পাই তখন কিন্তু গ্রাহকের কথা মাথায় রেখে তাকে জিজ্ঞেস করি, তিনি ঝাল পছন্দ করেন কি না। এছাড়াও রান্নার সময় বিভিন্ন উপকরণের পরিমাণের একটা বিষয় থাকে। এই বিষয়টা বেশি নজরে রাখতে হয়।’

গ্রাহকের সাড়া কেমন পাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো সাড়া পাচ্ছি, এতোটা গ্রাহকের প্রশংসা ও ভালোবাসা পাবো আশা করি নাই। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খাবার দেবার বিষয়ে কথা চলছে’।

বাবা সরকারী চাকুরিজীবি হওয়ায় মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুরশিদার। তবে ছোট বেলায় লেখাপড়া সহ আনুসাঙ্গিক বিষয় নিয়ে ব্যস্ততার জন্য রান্নায় এতোটা মনোযোগ দিতে পারেন নি।

তাহলে রান্নার প্রতি ভালোবাসাটা কীভাবে? উত্তরে খুরশিদা বললেন, মায়ের হাতের রান্না অসাধারণ ছিল। সবাই মায়ের রান্নার গুণের প্রশংসা করত। আমি মূলত বিয়ের পর রান্নায় মনোযোগ দিই। বিয়ের সাতদিন পর থেকে শাশুড়িকে আর রান্না ঘরে যেতে দিই নি। সেই থেকেই শুরু। এরপর নানান আয়োজন গুলোতে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবার কাছ থেকেই নিজের রান্নার গুণ ও যশ শুনতে শুরু করি। এখন পর্যন্ত রান্না করতে আমার ভালো লাগে এবং নিজের রান্না আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের খাওয়াতেও ভালো লাগে।’

রান্না বিষয়ক কোন কোর্স করেছেন কী? দু সন্তানের জননী খুরশিদা জাহান জানালেন, তার গ্রামের বাড়ি নারায়নণগঞ্জ, সেখানকার মানুষ অনেক ভালো রান্না করে। রান্নার কোন কোর্স করা না থাকলেও পারিবারিকভাবেই রান্নার বিষয়টা মাথায় ঢুকে গেছে। তার বাবার পরিবার সহ মায়ের পরিবারের প্রত্যেকে খুবই ভালো রান্না করত। মায়ের রান্না দেখেই রান্না শিখেছেন আর শ্বশুরবাড়িতে পেয়েছেন শাশুড়ির অবাধ স্বাধীনতা।

দেশের শ্রদ্ধেয় রন্ধনশিল্পী অধ্যাপিকা সিদ্দীকা কবিরের প্রভাব তার রান্নার ওপর পড়েছিল।

সিদ্দিকা কবীরকে অপ্রাতিষ্ঠানিক গুরু আখ্যায়িত করে খুরশিদা জাহান বলেন, ‘সিদ্দিকা আপার প্রতি একটা ভালো লাগা সব সময়ই কাজ করে। মন থেকে তার প্রতি দোয়া থাকে। টিভিতে যখন সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি অনুষ্ঠিত হতো তখন পরিবারের সবাই মিলে সেটা দেখতাম। তার প্রতি কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই। আমরা সিদ্দিকা আপার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি।’

সিদ্ধেশ্বরী গালর্স কলেজ থেকে সমাজ কল্যাণে মাস্টার্স করা খুরশিদা জাহান এক সময় কাজ করেছেন দেশের বেশ কয়েকটি প্রথম সারির বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাতেও। পরে সন্তানদের লালন পালন, লেখাপড়ার জন্য আর চাকরি করেন নি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন উদ্যোক্তা হিসেবে।

খাবারের ব্যবসায় কোন প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘খানিকটা তো আছেই। আমি উদ্যোক্তা, আমি বুঝি এটা একটা সার্ভিস, একটা ব্যবসা। কিন্তু অনেক মহিলা কিংবা পরিবার এগুলো বুঝতে চায় না। তারা বিষয়টাকে নীচু করে দেখেন আর মনে করেন রান্না করে ব্যবসা করা অসম্মানজনক। যেটা কখনোই কাম্য নয়। এমন হীন মন-মানসিকতার থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি এটা আমার সৃজনশীলতা, এটা কখনোই অসম্মানজনক হতে পারে না।’’

খাবার ডেলিভারির বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘নিজস্ব ব্যবস্থার পাশাপাশি আমি ঐক্য স্টোরের সঙ্গে যুক্ত আছি। আমি মনে করি ঐক্য আমার নিজেরই একটা প্ল্যাটফর্ম। কারণ আমি যেমনভাবে আমার ব্যবসাটাকে চিন্তা করি, ঠিক ঐক্যও আমার ব্যবসাকে আমার মতো করেই চিন্তা করে। আমার বুটিকসের ক্ষেত্রেও যেমনটা ঐক্য করেছে ঠিক সেভাবেই ‘ঘরের খাবার’ এর জন্য ঐক্য কাজ করছে’’।

পাঠকদের উদ্দেশে হাসি মাখা মুখে খুরশিদা বললেন, ‘রান্নার প্রতি ভালোবাসা রাখুন, সামর্থ্য অনুযায়ী রান্নায় বৈচিত্র্য আনুন। উপভোগ করুন আপন রসনা। রান্নায় রয়েছে বাঙালিদের নিজস্ব এক ঐতিহ্য’।

ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here