মানুষের স্বপ্ন আসলে ছোটবেলার স্বপ্ন। বড়বেলায় আসলে শুধুই পরিণতি। প্রত্যেক ব্যক্তি মানুষ, মানুষ ব্যক্তি না। এমন অনেক চিন্তা চেতনা নিয়ে ছোট্ট বেলা থেকে একটু ভিন্নভাবে ভাব-দর্শন নিয়ে বেড়ে ওঠা সাঈদ হাফিজের। ঝিকরগাছা এমএল মডেল হাইস্কুল, শহীদ মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স এবং মাস্টার্স বাংলা সাহিত্যে। রবীন্দ্রনাথ এর একটি কথায় ভীষণ তাড়িত হন এক যুবক, “প্রচুরতম লোকের প্রভূততম উন্নতি”- এই ভাবনা ভাবিয়ে তুলেছে এক তরুণকে।
বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের কথায় তরুণ ছুটে চলে- “মনুষ্য হইয়া জন্ম লইয়া যদি অপর মনুষ্যের প্রণয়ভাগী হইতে না পারিলে, তবে মনুষ্য জনম বৃথা”।
বাংলাদেশ সামাজিক পরিষদ ২০০৫ সালে গড়লেন এক যুবক। ছাত্র অবস্থায় হাত খরচ থেকে ১০০ টি বই কিনে দিতেন প্রতি মাসে যুবকটি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ পারি দিয়েই প্রতিদিন তরুণ যেতেন তার কাজে। সবুজে সবুজ কপোতাক্ষ নদ।
তরুণ ২০১৩ সালে প্রথম কচুরিপানাকে টেনে নিলেন হাতে। শুরু করলেন গবেষণা। কচুরিপানার প্রথম তন্তু যেদিন যুবক বানালেন সেদিন যুবক সাঈদ হাফিজ প্রথম সোজাভাবে কিছু ভাবতে শুরু করলেন। কিছু হতে চলেছে। কিছু একটা করা সম্ভব। অনেক ঝলমলে আনন্দ সাহিত্য অনুরাগী তরুণকে রংধনুর আলোক ছটা দিয়ে ঘিরে ধরলো যেনো।
অনেক দিন হাফিজ ভাবেন এবং ইন্টারনেটে পড়াশোনা করতে থাকেন বিস্তর। লিটারেচার মিলে ১৮০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি এক ব্রাজিলিয়ান যে কচুরিপানার ফুল ভারতীয় উপমহাদেশে এনেছিলেন সেই কচুরিপানায় তো বাংলাদেশের নদী-নালা, খালবিল ছেয়ে ফেললো। তরুণ হাফিজের গবেষণাতে উঠে আসলো, কচুরিপানাকে নোংড়া, জঞ্জাল, ক্ষতিকর বা যে কচুরিপানা সূর্যের আলোকে নদীর পানির ভেতর প্রবেশ করতে দেয় না সেই কচুরিপানাকে পরিবেশের জলাধারের ক্ষতি করতে না দিয়ে ভালো কাজ কি করা যায় এই কচুরিপানা দিয়ে, যা দিয়ে সমাজের, দেশের উপকার হবে, দেশের উন্নতি হবে, মানুষের কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে যাবে আনবে আর জয় করবে এমনই দর্শন নিয়ে তরুণ উদ্যোক্তা সাঈদ হাফিজ নামলেন তার কর্মভুবনে। সিদ্ধান্ত নিলেন উদ্যোক্তা হবেন।
প্রথমে তৈরি করলেন জৈব সার, তারপর কাগজ। প্রথম প্ল্যান বাদ। প্রথম ধাপের গবেষণা শেষ করে তৃতীয় হলেন হস্তশিল্প তৈরিতে। হ্যান্ডিক্রাফটের চাহিদা রয়েছে সারা বিশ্বেই। বানাতে শুরু করলেন পণ্য। একটি ম্যাট বানালেন নিজ হাতে, আত্মবিশ্বাস বাড়লো। একটি ব্যাগ, একটি হ্যাট এবং কিছু শো-পিস। হেসে উঠলো যেনো তরুণ উদ্ভাবক, তরুণ উদ্যোক্তার কর্মক্ষেত্র। এইতো তৈরি হচ্ছে। আইডিয়ালাইজেশনের পর আড়াই বছর কেটে গেলো। তরুণ নিমগ্ন থাকেন তার গবেষণায়, তার কর্মে।
তরুণ উদ্যোক্তার কর্ম উপস্থাপিত হলো উপজেলা নির্বাহী পরিষদের বিভাগীয় কমিশনারের সামনে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার জনাব আজমল হক প্রথম প্রদর্শন করলেন এমন ইনোভেটিভ আইডিয়া, এমন পরিবেশ বান্ধব পণ্য। বিভাগীয় পুরস্কার মিলে গেলো তরুণ উদ্যোক্তার। বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের পুরস্কার। প্রকৃতি থেকে পরিবেশ বান্ধব পণ্য তৈরি করবার এবং পরিবেশকে সুন্দর রাখবার এবং তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবার পথেও হাটা শুরু হলো। শিমুলিয়া গ্রামে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যারা নানান পণ্য তৈরি করে আসছিলেন তাদের প্রথম একজন কে কাজ এবং নকশা বুঝিয়ে কাজ দিলেন তরুণ উদ্যোক্তা সাঈদ হাফিজ।
পণ্য উৎপাদন শুরু হলো।
একজন দুজন করে কাজ পেতে শুরু করলেন শিমুলিয়া গ্রামের নারীরা এবং একএক করে কর্মী সংখ্যা বেড়ে দাড়ালো ৩০ জনে। আজ শতশত নয়, হাজার হাজার নারীর কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করেছেন তরুণ উদ্যোক্তা সাঈদ হাফিজ। এক নতুন কর্ম-সংস্থান সৃষ্টি করেছেন নতুন এক আশার আলো জ্বলে উঠেছে শিমুলিয়া গ্রামে। পণ্য তৈরি হতে থাকলো- হ্যান্ড ব্যাগ, কুলা, সার্ভিং ট্রে, লেডিস ব্যাগ, সাইড ব্যাগ, গহনার বাক্স, টেবিল ম্যাট, ফ্লাওয়ার বাসকেট, ফ্রুট বাসকেট, লন্ড্রি বাসকেট, ট্র্যাশ ক্যান, ফ্লাওয়ার পট, পেন হোল্ডার, টিস্যু বক্স, স্লিপার শু, অফিস হোল্ডার, কুশন, সিকা, কলস, জার, টেবিল রানারের মত শতশত পণ্য।
নিবিড় গবেষণায় এবং আন্তর্জাতিক ডিজাইন পড়াশোনা করে প্রতিনিয়ত উদ্যোক্তা শাণিত করছেন পণ্যের গুণগত মান, টেকশই অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক মানের হস্তশিল্প তৈরির কাজ।
আজ গঙ্গানন্দপুর, ঝিকরগাছা, শিমুলিয়া মুখরিত হয়ে ওঠে উদ্যোক্তার কর্মপদচারণায়। উদ্যোক্তার চোখে-মুখে দীপ্তির আলো ছড়ায়।
১৯৩৬ সালে একটি আইন হয়েছিলো। কচুরিপানা আইন। কঠোরভাবে তা বাস্তবায়নও করেছিলেন সে সময়কার সরকার। বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তা সাইদ হাফিজই প্রথম চিন্তা করলেন কচুরিপানার ঋণাত্মক যে অবস্থান এবং এর যে ভাবমূর্তি এবং কাঁচামাল হিসেবে কচুরিপানার যে সহজলভ্যতা একে যদি প্রক্রিয়াজাত করে পুরো উল্টো একটি কর্মে একে প্রমাণ করা যায়, কাজে বসলে তা হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ বিপরীত। এমন সব উদ্ভাবনী চিন্তায় দূর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়েছেন উদ্যোক্তা সাঈদ হাফিজকে। পণ্যের সংখ্যা, প্রোডাক্ট লাইন বাড়তেই থাকে।
২০১৮ সালে যশোরে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় একটি স্টল নিয়ে বসে ছিলেন তরুণ উদ্যোক্তা সাঈদ হাফিজ। এ টু আই এর এক সম্মানিত প্রকল্প পরিচালক কবির বিন আনোয়ার তার পণ্য দেখে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠলেন, বললেন এ টু আই তে এপ্লাই করতে। হাজার হাজার উদ্ভাবনই প্রকল্পের মধ্যে দেশ সেরা তরুণ উদ্ভাবকের স্বীকৃতি মিললো সাঈদ হাফিজের। সেরা ১০ এর মধ্যেই থাকলেন সাঈদ। আজ একটি অঞ্চলকে পুরো চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন সাঈদ হাফিজ। যশোর এবং কপোতাক্ষ নদ, যে নদ দেখলেই পুরো সবুজ দেখা যায় গঙ্গানন্দপুরে দাঁড়িয়ে এবং তা কচুরিপানায় ঢাকা। কপোতাক্ষ নদের কচুরিপানায় সাঈদ হাফিজের কাঁচামাল প্রাপ্তির শক্তি ও মূল উৎস।
বিশ্বমানের পণ্য বানিয়ে কর্ম-সংস্থান সৃষ্টি করে কপোতাক্ষ নদকে ঝকঝক ও রূপালি রূপে সুন্দর করতে চান সাঈদ হাফিজ তার উদ্যোগ দিয়ে তার কচুরিবাজার। তরুণদের সম্পৃক্ত করছেন কচুরিবাজারে, বিপণন বিভাগকে করছেন শক্তিশালী ধীরেধীরে। তরুণ সহ যোদ্ধা হয়েছেন নিশিত রচনা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সুশান্ত কর্মকার, সোশ্যাল মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর হিসেবে। ৩০০ এর উপর আজ পণ্য সাঈদ হাফিজের প্রোডাক্ট লাইনে। বাংলাদেশ তো বটেই- আজ ইউরোপ, আমেরিকা এমন সব দেশ গুলোতে এবং অন্যান্য দেশগুলোর বাজারেও যে বিপুল চাহিদা বাংলাদেশের পরিবেশ বান্ধব হস্তশিল্প পণ্যের সেই পথেই কাজ করে চলেছেন উদ্যোক্তা সাঈদ হাফিজ। দৃঢ় প্রত্যয়ী উদ্যোক্তা এগিয়ে চলেছেন তার কর্মে।
কচুরিপানা ফুরাবে না। সম্ভাবনাও অসীম। কাঁচামাল প্রকৃতি প্রদত্ত। প্রকৃতি থাকবে সুন্দর এবং পরিবেশ হবে সংরক্ষিত। প্রকৃতি, নদী-নালা কচুরিপানা মুক্ত থাকবে আর হবে হাজার- লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান। হস্তশিল্পে বিশ্ববাজারে ভেসে উঠবে একটি দেশ, বাংলাদেশ।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা