ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের আধুনিকায়ন

0
ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের আধুনিকায়ন

প্রত্যেক দেশেরই রয়েছে নিজস্ব শিল্প ও সংস্কৃতি। একেকটি শিল্পের বিস্তারে রয়েছে দেশ এবং জাতির অবদান। বাংলাদেশের অন্যতম শিল্প মৃৎশিল্প। রূপ বৈচিত্রের বাংলাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক অনেক গভীর। ‘মৃৎ’ শব্দের অর্থ মৃত্তিকা বা মাটি আর ‘শিল্প’ বলতে এখানে সুন্দর ও সৃষ্টিশীল বস্তুকে বোঝানো হয়েছে। এজন্য মাটি দিয়ে দিয়ে তৈরি সব শিল্পকর্মকেই মৃৎশিল্প বলা যায় এবং যারা এই শিল্পকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের বলা হয় কুমার। কুমাররা শৈল্পিক দক্ষতা ও মনের মাধুর্য দিয়ে চোখ ধাঁধানো সব কাজ করে থাকেন। এই শিল্পটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও অন্যতম একটি শিল্প যা ঐতিহ্য বহন করে।

কিন্তু, প্রাচীনকাল থেকে বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। আজকাল কুমারপাড়ার মেয়েদের ব্যস্ততা অনেক কমে গেছে। কাঁচামাটির গন্ধ তেমন পাওয়া যায় না। হাটবাজারে আর মাটির তৈজসপত্রের পসরাও তেমন বসে না। তবে নির্মম বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো কিছু জরাজীর্ণ কুমার পরিবার ধরে রেখেছেন বাপ-দাদার এই ব্যবসা। বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্য বৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যাসহ নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প। শুধু তাই নয়, প্লাস্টিক, স্টিল, ম্যালামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা তৈজসপত্রের সুবিধার কারণে দিন দিন আবেদন হারাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম।

মৃৎশিল্পের সঙ্গে চীনের বড় একটা ঐতিহ্য আছে। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা গেছে, চীনের বিখ্যাত শহর থাংশান-এ মৃৎশিল্পের জন্ম হয়েছিল। আর এ কারণেই এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়।এই শহরের পথে-প্রান্তরে, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্কগুলোতে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। থাংশানের মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত মিং রাজবংশের ইয়ুং লে-এর সময়কালে। শহরটির রয়েছে প্রায় ৬০০ বছরের ইতিহাস। এখানে নানা ধরনের চীনামাটির ৫০০টিরও বেশি মৃৎশিল্প রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন রকম মাটির মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্য চীনামাটি, স্বাস্থ্যসম্মত চীনামাটি, শিল্পায়ন চীনামাটি, হাইটেক চীনামাটি, শিল্পকলা চীনামাটি অন্যতম। বিভিন্ন দোকানে গিয়ে অনেক ক্রেতা এখনো চীনের তৈরি জিনিসপত্র খোঁজ করেন।

চীনা শিল্পের যেমন ঐতিহ্য আছে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশেরও আছে। অতীতে গ্রামের সুনিপুণ কারিগরের হাতে তৈরি মাটির জিনিসের কদর ছিল অনেক। পরিবেশ বান্ধব শিল্প শোভা পেতো গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ তা হারিয়ে যেতে বসেছে।

বাংলা মৃৎশিল্পের এক জনপথ হলো ঢাকা জেলা। বংশী নদীর পাড় ঘেঁষে কাগজিয়াপাড়া, ধামরাই পৌরসভার পালপাড়া, সাভারের নবীনগর, নলাম, ভাগলপুরসহ একাধিক স্থানে কয়েকশ বছর ধরে তাদের বসতি। তবে কাজের সেই জৌলুস ও ব্যস্ততা এখন আর নেই। বাঁচার তাগিদে অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ ধরে রাখলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় তারা জর্জরিত। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কুমারদের। এ মানুষগুলোকে সহযোগিতা করার কেউ নেই। নেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। তারপরও অনেক সংগ্রাম করে পোড়ামাটির গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিকৃতি, শো-পিসসহ অসংখ্য জিনিস কুমারশালায় তৈরি হচ্ছে। এই সম্প্রদায়ের লোকজনেরা মাটির তৈরি করা পাকপাতিল, ঠিলা, কলসি, পুতুল, কুয়ার পাট, খেলনার সামগ্রী, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি হাটবাজারে বা গ্রামে গ্রামে বড় ঝাঁকা বোঝাই করে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। ছয় মাস ধরে তারা মৃৎশিল্প তৈরি করে আর ছয় মাস বিভিন্ন কায়দায় বিক্রি করতেন। এখন বিশেষ বিশেষ সময়ে অনুষ্ঠিত মেলায় দেখা মিলে মাটির তৈজসপত্র। বিশেষ করে বাংলা সালের বিদায় ও বরণ উৎসবে মেলায় আগতদের হাতে হাতে স্থান পায় এসব মাটির জিনিস।

আধুনিকতার ছোঁয়া লাগায় চারুকলার শিক্ষার্থী কিংবা বর্তমান তরুণ প্রজন্ম দেশীয় এই সংস্কৃতিকে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে মৃৎশিল্পকে কাজে লাগিয়েছেন ভিন্নভাবে। নতুন করে মৃৎশিল্পের আর একটি শাখা উন্মোচিত হয়েছে। সেটি হলো নান্দনিক মৃৎশিল্প। এ শাখার মৃৎশিল্পীরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিনসামগ্রী ও শিল্পকর্ম তৈরি করে থাকেন, ইংরেজিতে একে বলা হয় পটারি। এরা টেরাকোটা বা মৃৎফলকে খোদাই করে সুন্দর সুন্দর শো-পিস তৈরি করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন মূর্তি, অলঙ্কার, নকশিপাত্র, ঘণ্টা ইত্যাদি তৈরি করছেন তারা। ঢাকার অনেক দোকানে এসব শৌখিন মৃৎসামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।

এসব কারণে মৃৎশিল্প কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ৫২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে মৃৎশিল্প। রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। বিদেশে মূলত মাটির তৈরি পামিজ, ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গার্ডেন প্রডাক্ট, নাইট লাইট, ডাইনিং আইটেম, ইনডোর গার্ডেন আইটেম, ফুলদানি, মাটির টব ও মাটির ব্যাংকের চাহিদা আছে। ব্যাপক ভিত্তিতে মাটির তৈরি জিনিস রপ্তানি করা গেলে আরো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেত।

এজন্য আধুনিক উৎপাদনে অগ্রসর হতে হবে। আধুনিক ইলেকট্রিক্যাল চাক, ইলেকট্রিক্যাল চুল্লি, ফায়ার ব্রিক স্লাব, ফার্নেস অয়েল, গ্যাস ফায়ার, গ্লেজ ফায়ার, অক্সাইট, সিলিকেট, ব্যবহারে প্রশিক্ষিত করতে পারলে কুম্ভকারদের দুঃখ লাঘব হবে। তাছাড়া মৃৎশিল্প সামগ্রী প্রাচীন ঐতিহ্যে নির্মাণ হলেও মৃন্ময়পাত্রের সমকালীন চাহিদা অনুযায়ী সরকারি, বেসরকারি, আর্থিক সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কিংবা মৃৎশিল্পীদের উদ্যোগে একটি সংগঠন করে পর্যায়ক্রমে এর পরিধি প্রসারে তদারকি প্রয়োজন। এটি শুধু শিল্প নয়, আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমার এবং পালদের সহজ শর্তে ঋণ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্নমুখী উৎপাদন বাড়াতে হবে।

সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here