১১ দেশে রপ্তানি হচ্ছে আকিবের টোপ ও চার

0
উদ্যোক্তা এইচ আতাউর রহমান আকিব

রাজশাহীর এইচ আতাউর রহমান ওরফে আকিব। কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন মেক্সিকোর ইউনিভার্সিদাদ ডেল গলফো দে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটিতে। তারপর ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডে স্নাতকোত্তর। ছিলেন একজন শখের মৎস শিকারী। বলা যায় ছোটবেলা থেকেই মাছ ধরা আকিবের নেশা ছিলো। সে নেশাই আজ তাকে করেছে পুরোদস্তুর একজন উদ্যোক্তা। দেশের বাইরে থেকে ডিগ্রি অর্জন করা আকিব রাজশাহীর নিজ বাসাতেই গড়েছেন মাছ শিকারের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান টোপ এবং চার তৈরির কারখানা।

বাংলাদেশের একমাত্র নিবন্ধিত ও অনুমোদিত গেম ফিশিং কঞ্জিউমেবলস ব্র্যান্ড, ম্যানুফাকচারার ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান “প্রিমিটিভ ফিসিং বাই আকিব।” প্রতিষ্ঠানটির স্বত্ত্বাধিকারী এইচ আতাউর রহমান আকিবের নামে এটির নামকরণ। এখানে মাছ শিকারের জন্য টোপ, চার, ফেরোমন স্প্রে এবং তেল তৈরি করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শুধু তাঁর কারখানতেই তৈরি হয় আগুনজল নামক একটি ফেরোমন স্প্রে। এই প্রতিষ্ঠানে দৈনিক টোপ-চার উৎপাদন ক্ষমতা ৩.৫ মেট্রিক টন (ম্যানুফাকচারিং) এবং ১.২ মেট্রিক টন (প্যাকেজিং)। সারাদেশে তো বটেই, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়াসহ এশিয়া ও ইউরোপের ১১ টি দেশে উদ্যোক্তা আকিবের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

চার-পাঁচ বছর বয়স থেকেই মাছ ধরার প্রতি ভালোবাসা আকিবের। তখন তিনি পরিবারের সাথে বাস করতেন রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। ওইসময় তার বাড়ির পাশেই ছিল বিশাল এক বিল। সেখানে কাজিন এবং সমবয়সী বন্ধুদের সাথে বিল দেখতে যেতেন নিয়ম করে এবং মাঝে মধ্যে মাছ শিকারও করতেন। এভাবে মাছ শিকারের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয় আকিবের। তবে আর দশজন থেকে উদ্যোক্তা আকিবের মাছ শিকারের দর্শন সম্পূর্ণই আলাদা। ‘মৎস মারিব খাইব সুখে’ এমন ভাবনার বাইরে এসে মাছ নিয়ে আরেক পৃথিবীর সন্ধান পেতে পানের আকিবের ভাবনায়। কারণ মাছ ধরে খাওয়ার চেয়ে ছেড়ে দেওয়ার আনন্দই বেশি- এমন বিশ্বাসে বিশ্বাসী আকিব।

অকল্যান্ডের গ্রিনহাইট থেকে বাংলাদেশের পদ্মা, যমুনা অসংখ্য স্থানে মাছ শিকারের অভিজ্ঞতা রয়েছে আকিবের। সেই অভিজ্ঞতা থেকে “ছিপ বড়শি” নামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তার উপলব্ধি, মৎস শিকারের প্রচলিত যন্ত্র এবং পদ্ধতি, বিভিন্ন ধরনের টোপ-চার তৈরি, মাছের লেয়ার ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

উদ্যোক্তা বার্তাকে এইচ আতাউর রহমান আকিব বলেন, “স্নাতকোত্তর শেষ করার আগেই চাকরিতে ঢুকে পড়েছিলাম। দেশের বাইরে বেশিরভাগ সময় আমার নিউজিল্যান্ডে কেটেছে। ওখানে লক্ষ্য করতাম ফিলিং স্টেশনগুলো ২৪ ঘন্টা খোলা রয়েছে এবং পেট্রোল, মবিল, তেলের পাশাপাশি কুকুর-বিড়ালের খাবার যেমন পাওয়া যায়, তেমনি মাছ ধরার উপকরণও পাওয়া যায়। এগুলো দেখে মাছ ধরার শখ আমায় নতুন করে পেয়ে বসলো। যেহেতু হাতের নাগালেই মাছ শিকারের উপকরণ পেয়ে যাচ্ছি- তাই পড়াশোনা, চাকরির পাশাপাশি মাছ শিকারও চলতে থাকে। ২০১৭ সালে গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমাকে। বাবা অসুস্থ হওয়ায় দেশে ফিরে এলাম। এরপর থেকে রাজশাহীতে নিজ বাসায় পরিবারের সকলের সাথে বাস করছি।”

দেশে ফিরে যখন মাছ ধরতে গেলেন প্রথম দিকে বেশ ভালোই ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হতো। “সেসময় কিছুটা ধাক্কাই খেলাম বলা চলে। মাছ ধরার অনুমোদিত কোনো টোপ-চার নেই। নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় পিঁপড়ার ডিমের সঙ্গে পাউরুটি মেখে টোপ বানানো ও হাতে বানানো মিষ্টি চার পাওয়া যেতো, এসব দিয়েই মাছ শিকার করতাম।”

তিনি বলেন: একটা সময় মাছ শিকার বিষয়ে ভিডিও তৈরি করতে আরম্ভ করি। ইউটিউবে আপলোড শুরু করলে অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক ফলোয়ারও জুটে যায়। প্রতিদিন এই ভিডিওগুলো দেখতে শুরু করেন শখের শিকারিরা। মন্তব্য করেন, নানা পরামর্শও চাইতে থাকেন। মানুষের আগ্রহ দেখে যেমন অনুপ্রাণিত হলাম, তেমনি চিন্তা শুরু হলো এভাবে নির্বিচারে টোপের জন্য পিঁপড়ার ডিম ব্যবহার করলে তো প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। বিকল্প ভাবতে শুরু করলাম। নিউজিল্যান্ডে যে ছয় বছর ছিলাম সেখানে মাছ শিকার করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি মাছের বুদ্ধি কম। ব্যথা অনুভব করে কম। পরিপাকতন্ত্র সুগঠিত নয়। সহজে হজম হয় এমন জিনিসের প্রতি মাছের আকর্ষণ। টোপ ও চার বানানোর সময় এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতাম। পানি দূষণ হবে না, মাছের শারীরিক কোনো সমস্যা হবে না, জিনিসটা হবে পরিবেশবান্ধব- এসবও বিবেচনায় থাকে। এক পর্যায়ে বাড়িতেই তৈরি করলাম টোপ ও চার তৈরির কারখানা। যা নিজেও ব্যবহার করতাম। এভাবেই দিনে দিনে প্রচার পেতে থাকলো পরিচিতদের কাছে, বাড়তে থাকলো কারখানার পরিসর। চার বছর আগে দুই হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে উদ্যোক্তা জীবনে আসা। এখন আমার সাথে অসংখ্য সহযোদ্ধা কাজ করছেন।”

বর্তমানে মাছের প্রকারভেদ এবং মাছের আকার অনুযায়ী
কারেন্ট চার, পদ্মমধু, মহুয়া চার, তেল চার, জাফরানি ছাতু, রেডি টোপ, ফিরনি টোপ, মাছ শিকারের বিরিয়ানি পাউডার, কস্তুরি মসলা, মহুয়া পুডিংসহ ১৪ ধরনের টোপ-চার তৈরি হচ্ছে আকিবের কারখানায়।

রাজশাহীতে আকিবদের বাসার তৃতীয় তলায় তার কারখানা। পাঁচটি যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন হচ্ছে টোপ ও চার। বড় বড় ড্রামে কাঁচামাল ভরে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে মেশিনে দেওয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে প্যাকেটজাত হয়ে বেরিয়ে আসছে। আরেকটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে বোতলে মাছ ধরার তেল ভরা হচ্ছে। এসব কাজ করছেন ১৫ জন প্রশিক্ষিত সহযোদ্ধা। রাজশাহী এবং ঢাকাতে রয়েছে তার নিজস্ব ‘ট্যাকেল শপ’ এবং ভারতে রয়েছে একটি আউটলেট। খুব শীঘ্রই নিউজিল্যান্ডে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন এই উদ্যোক্তা। এছাড়াও টোপ-চারের পাশাপাশি তার কারখানায় তৈরি হবে উন্নত মানের ছিপ এবং বড়শি।

পাশাপাশি ইউটিউবে চলছে তার কার্যক্রম যেখানে তিনি মাছ ধরাতেও যে নীতিনৈতিকতা আছে, সেটা তুলে ধরেন। মাছ ধরায় নানা দেশে নানা নিয়ম আছে। যেমন নিউজিল্যান্ডে মাছের আকার ৯ থেকে ৩০ সেন্টিমিটারের মধ্যে হতে হয়। সর্বোচ্চ আকারের ৭টির বেশি মাছ শিকার করা যায় না। আকিব তার এমন নানা অভিজ্ঞতা শিকারিদের জানাতে ভিডিও বানান। সেসব তুলে দেন ইউটিউব চ্যানেলে। মাছের স্বাস্থ্য, নদীর পানি ও পরিবেশ বিষয়ে শৌখিন মাছশিকারিদের সচেতন করেন। তার ইউটিউব চ্যানেলের নাম ‘প্রিমিটিভ ফিশিং বাই আকিব’। সাবস্ক্রাইবার ১ লাখ ৯১ হাজার।

মাছ শিকারের নীতিনৈতিকতার মূল কারণ হচ্ছে পৃথিবীতে কিছু মাছ আজ বিলুপ্তপ্রায়। এর মূল কারন অপরিকল্পিত ভাবে মাছ শিকার। বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় একটি মাছ মহাসোল। ভারতের উত্তর অঞ্চলে এখনো অনেক মহাসোল পাওয়া যায়। সাম্প্রতি আকিব গিয়েছিলেন বিশেষ অনুমতিতে ভারত এবং নেপাল বর্ডারের কালী নদীতে মহাসোল শিকার করতে। তিনি সেখানে ৪১.০৮ পাউন্ডের মহাসোল শিকার করেন। পরে ৭৩ পাউন্ডের আরো একটি মহাসোল শিকার করেন তিনি। মাছ শিকারের পর যত্নসহ পর্যবেক্ষণ করে স্যাম্পল সংগ্রহের পর মাছ দৃটি নদীতে আবার নদীতে ছেড়ে দেন। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সংস্থার সাথে আকিব মাছ সংরক্ষণের বিষয়েও বেশ সক্রিয় আছেন।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। ইন্টারন্যাশনাল গেম ফিশ অ্যাসোসিয়েশনের তিনি সদস্য। পদ্মায় ১২ কেজি ৭৭০ গ্রাম ওজনের কাতলা মাছ ধরার জন্য এই সংস্থা তাকে ‘ক্যাচ’ সার্টিফিকেট দিয়েছে। আকিব জানান, দেশে তিনিই একমাত্র আন্তর্জাতিক সংস্থার ক্যাচ সার্টিফিকেটধারী মৎস্যশিকারি।

তামান্না ইমাম,
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here