সারা বিশ্বে আমের মতো জনপ্রিয় ফল আর নেই। এমন কোন জাতি নেই যারা আম পছন্দ করে না। সবার পছন্দের আমকে ʼফলের রাজাʼ বলা হয়। এশিয়া মহাদেশের প্রায় সব দেশেই পাওয়া যায় আম। গ্রীষ্মকালীন সময়ে বাংলাদেশে বাহারি জাতের আম পাওয়া যায়। জাতীয় ফল না হলেও বাংলাদেশে আমই সবচেয়ে জনপ্রিয়। এই আম চাষ করে অনেক কৃষি উদ্যোক্তা আজ স্বাবলম্বী। তাদের উৎপাদিত আম দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
আমের প্রায় কয়েকশ জাত রয়েছে, প্রজাতির সংখ্যা ৩৫। আমের আকার, আকৃতি, মিষ্টতা, ত্বকের রঙ এবং ভেতরের ফলের বর্ণ – জাতভেদে পরিবর্তিত হয়। ভারতের মালদহ, মুর্শিদাবাদে প্রচুর আম চাষ হয়। বাংলাদেশের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, দিনাজপুর, নাটোর, সাতক্ষীরা ও যশোরে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ বেশি হয়ে থাকে। আম ভারত ও পাকিস্তানের জাতীয় ফল, এবং বাংলাদেশের জাতীয় গাছ।
আজকের এ ফিচারটি দেশের বাহারি আম এবং বাণিজ্যিক সফলতা প্রসঙ্গে।
বাংলাদেশে জনপ্রিয় আমের জাত:
ফজলি: আমের মধ্যে অনেক জনপ্রিয় একটি নাম ফজলি। রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুখ্যাতি রয়েছে ফজলি চাষের জন্য। ফজলি আম গড়ে লম্বায় ১৩.৮ সে.মি. চওড়ায় ৯.৫ সে.মি. উচ্চতায় ৭.৮ সে.মি. হয়। গড়ে ওজন হয় ৬৫৪.৪ গ্রাম। আমটি দীর্ঘ এবং ঈষৎ চ্যাপ্টা। পাকা আমের খোসা কিছুটা হলুদ হয়ে ওঠে। এই আমে শর্করার পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে, বা মোটামুটি জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহ থেকে এই আম পাকতে শুরু করে।
হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাতি: হিমসাগর আমের বহুল জনপ্রিয়তার কারণে একে বলা হয় আমের রাজা। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও সাতক্ষীরার আম বিশ্ব জোড়া প্রসিদ্ধ তার মিষ্টি স্বাদ ও সুগন্ধের জন্য। এই আমের ভেতরের রং হলুদ ও কমলা (রং) এবং কোন আঁশ নেই। হিমসাগর আম জুন মাসে গাছে পাকতে শুরু করে এবং জুনের শেষদিকে পূর্ণ বাজারজাত হয়।
ল্যাংড়া: এটি আমের একটি বিখ্যাত জাত যা ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে চাষ হয়। জুলাই মাসের দিকে এই আম পাকতে শুরু করে এবং বাজারে পাওয়া যায়। দেশে যে কটি উৎকৃষ্ট জাতের আম রয়েছে তার মধ্যে ল্যাংড়া সবচেয়ে এগিয়ে। অত্যন্ত রসালো এই ফলটির মিষ্টতার পরিমাণ গড়ে ১৯.৭%। বোঁটা চিকন, আঁটি অত্যন্ত পাতলা। পোক্ত হবার পর সংগ্রহীত হলে গড়ে ৮-১০ দিন রাখা যায়।
গোপালভোগ: আমের রাজা ল্যাংড়ার পরই গোপালভোগের স্থান। এই আমটির আকার গোলাকার এবং ওজনে ২০০ থেকে ৫০০ গ্রামের মধ্যে। উন্নত প্রজাতির আম মৌসুমের শুরু থেকে মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাওয়া যায়। অসাধারণ রং, অতুলনীয় মিষ্টি স্বাদ এবং সুমিষ্ট গন্ধ এর বিশেষত্ব। বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু অঞ্চলে গোপালভোগের উন্নত ফলন পাওয়া যায়। জৈষ্ঠ্য মাসের মাঝামাঝি ফল পাকতে শুরু করে।
আম্রপালি: ১৯৭১ সালে এই হাইব্রিড জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. পিযুষ কান্তি মজুমদার ‘দশেরী’ এবং ‘নিলম’ জাতের দুটি আমের সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন এ জাতটি উদ্ভাবন করেন। আম্রপালি জাতের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উন্নত জাতের আম এক গাছে এক বছর ফলে, পরের বছর ফলে না। কিন্তু আম্রপালি প্রতিবছর ফলে। এর মিষ্টতার পরিমাণ ল্যাংড়া বা হিমসাগরের চেয়ে বেশি। আম গাছটির গঠন ছোট, গাছে ছোট আকারের আমের গুচ্ছ ধরতে দেখা যায়। আমের রং কমলা-লাল এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক জাতের আমের তুলনায় এতে প্রায় ২.৫-৩.০ গুণ বেশি বিটা ক্যারোটিন থাকে। তবে এই গাছের জীবনকাল সংক্ষিপ্ত। গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ১৬ টন।
হাড়িভাঙ্গা: বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত ও সুস্বাদু আম। বিশ্ববিখ্যাত এ হাড়িভাঙ্গা আমের উৎপত্তি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়ন থেকে। আমের উপরিভাগ বেশি মোটা ও চওড়া, নিচের অংশ চিকন । দেখতে সুঠাম ও মাংসালো, শ্বাস গোলাকার ও একটু লম্বা। শ্বাস অনেক ছোট, আঁশ নেই। আকারের তুলনায় ওজনে বেশি, গড়ে ৩টি আমে ১ কেজি হয়। কোন ক্ষেত্রে একটি আম ৫০০/৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে। চামড়া কুঁচকে যায় তবুও পঁচে না । ছোট থেকে পাকা পর্যন্ত একেক স্তরে একেক স্বাদ পাওয়া যায়। জুলাইয়ে এই আম বাজারে পাওয়া যায়।
এছাড়াও লক্ষণভোগ, আশ্বিনা, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের আম পাওয়া যায়। এদেশের মাটি আম ফলনের অনূকুলে হওয়ায় আম চাষ করে কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন দেশের কৃষি উদ্যোক্তারা। কম-বেশি প্রত্যেক জেলায় আম চাষ হয়, তবে উত্তরবঙ্গ আম চাষের জন্য বিখ্যাত।
রাজশাহীতে এবার রেকর্ড আম উৎপাদনের সম্ভাবনা:
রাজশাহী জেলায় এবার আবহাওয়া অনূকুলে থাকায় রেকর্ড পরিমাণ আম উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ হিল কাফি জানান, ২০২২ সালে রাজশাহী আম উৎপাদনের আগের বছরের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর (২০২১-২২ মৌসুমে) ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে।
রাজশাহীর ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর আব্দুল আলিম বলেন, “এ বছর আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রতি হেক্টরে ১৫.৮৫ মেট্রিক টন। আমরা আশা করছি রাজশাহী জেলায় এবার আমের রেকর্ড-ভাঙা ফলন হবে কারণ চাষাবাদ বেড়েছে।”
নওগাঁতেও বাম্পার ফলন:
অপরদিকে কৃষিপ্রধান জেলা নওগাঁয় গত বছরের তুলনয় এ বছর আমের আবাদ বেড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে, এ বছর নওগাঁ জেলায় আমের বাম্পার ফলন হবে। আর উৎপাদন ছাড়িয়ে যাবে ৩ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি বিভাগের তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার (২০ মে) থেকেই নওগাঁতে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আম ভাঙা’ অর্থাৎ পারা শুরু হয়েছে। গুটি আম দিয়ে শুরু হয়েছে এ আনুষ্ঠানিকতা।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলার আমের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৭ মে থেকে গোপালভোগ ও রানিপছন্দ, ২ জুন থেকে খিরসাপাত ও হিমসাগর, ৪ জুন থেকে নাগফজলি, ১০ জুন থেকে ল্যাংড়া, ২০ জুন থেকে ফজলি, ২২ জুন থেকে আম্রপালি এবং ৮ জুলাই থেকে আশ্বিনা, বারি-৪ ও ঝিনুক জাতের আম ভাঙা শুরু হবে। নির্ধারিত এই সময় মেনেই আম ভাঙতে অনুরোধ জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
রংপুর:
জুনের মাঝামাঝি বাজারে আসছে রংপুরের সুস্বাদু হাঁড়িভাঙা আম। হাঁড়িভাঙা আমের জনপ্রিয়তার কারণে এখন রংপুরের বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ, নীলফামারীর সৈয়দপুর, সদর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে এই আমের বাগান। ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এসব বাগান গড়ে উঠেছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ওবায়দুর রহমান বলেন, এবার ১ হাজার ৮৮৭ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। গত বছরের তুলনায় ফলন কম হলেও হেক্টরপ্রতি ১২-১৫ টন আম আসবে। জুনের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে আসতে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও জুনের শেষ সপ্তাহে ভালোভাবেই বাজারে আম পাওয়া যাবে।
সাতক্ষীরা:
সাতক্ষীরা অঞ্চলের আমেরও বেশ পরিচিতি আছে। এই অঞ্চলের আম এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বিগত দু বছর করোনার সময়ে রপ্তানির পরিমাণ কম হলেও এই বছর বেড়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে সাতক্ষীরায় চার হাজার ১১৫ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের আমের চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৫০-৬০ হাজার টন। আমচাষি রয়েছেন ১৩ হাজার। এর মধ্যে কৃষি অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চাষি ৫০০। এসব চাষির বাগানের আম রপ্তানি করা হবে। সাতক্ষীরা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে ১০০ টন আম । আনুষ্ঠানিকভাবে হিমসাগর আম রপ্তানির মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়। পরে পাঠানো হবে গোবিন্দভোগ, ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, সারাদেশ থেকে চলতি বছর ৬০০ টন আম বিদেশে রপ্তানি হবে। তার মধ্যে সাতক্ষীরার আম থাকবে ১০০ টন। এসব আম ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স ও ডেনমার্কে যাবে।
সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা