অনলাইনে তিনি পিঠা বিক্রি করেছেন ১৩ লাখ টাকার

0
উদ্যোক্তা জান্নাতুল ফেরদৌস

ছোটবেলা থেকেই পিঠা বানাতে পছন্দ করতেন জান্নাতুল ফেরদৌস। এ বিষয়ে তার দক্ষতাও ছিল উল্লেখযোগ্য। বাংলার ঐতিহ্যবাহী সব পিঠা এবং যেসব পিঠা বিলুপ্তপ্রায়; সেসব পিঠা নতুনভাবে তুলে ধরার প্রয়াস থেকে পিঠা নিয়ে তার উদ্যোগ “Jannat’s kitchen”.

জান্নাতুলের জন্মস্থান নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার নদিয়াবাদ গ্রামে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএসএস করে ঢাকা ল’ কলেজ থেকে এলএলবি এবং বিআইএম থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা ইন পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট করেছেন। এছাড়া উইমেন ই-কমার্স ট্রাস্ট WE এর বদৌলতে বেশ কিছু অনলাইন ও অফলাইন কোর্স করেছেন দেশ-বিদেশ থেকে।

উদ্যোক্তা জান্নাতুল বলেন: পড়াশোনা শেষ করে একটা প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে মানবসম্পদ বিভাগে চাকরি করার পর একটা সময় ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর পর চাকরিটা আর কন্টিনিউ করতে পারিনি। কিন্তু কিছুদিন ঘরে থাকার পর যখন সময় আর কাটে না, তখন মাথায় আসলো উদ্যোক্তা হবো। কীভাবে হবো ভাবছিলাম। পরে মনে হলো ছোটবেলার দক্ষতাকে কাজে লাগাই। পিঠা নিয়ে কাজ করার আরেকটা কারণ বাংলার ঐতিহ্যকে নতুন করে তুলে ধরা। করোনাকালে সেটা শুরু হলো পুরোদমে। ওই সময়টাকেই আমি কাজে লাগালাম।

জান্নাতুলের কোন রেস্টুরেন্ট বা কারখানা নেই। ঘরে বসেই তিনি সব কাজ করেন । ২০১১ থেকে অফলাইনে পিঠা নিয়ে অল্প পরিসরে কাজ করতেন। তারপর ২০১৯ সালের শেষদিকে অনলাইনে টুকটাক সেল শুরু করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যোক্তা জীবন শুরু করেন ২০২০ সালের জানুয়ারির ১ তারিখ। মূলত ছেলের ইচ্ছাতেই ২,০০০ টাকা মূলধন দিয়ে অনলাইনে পিঠা নিয়ে কাজ শুরু করেন জান্নাতুল।

এ পর্যন্ত জান্নাতুলের পিঠার ক্রেতা ১৭শ’র উপরে। এর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশই রিপিট কাস্টমার। জান্নাতুল তার এলাকার প্রায় দেড়শ বছরের বিলুপ্তপ্রায় পিঠা ‘সতীন মোচড়’নতুনভাবে পরিচিত করাতে পেরেছেন। বরিশাল অঞ্চলের বিলুপ্তপ্রায় ‘বস্তা পিঠা’ও নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন।

প্রতিদিন তিনি অনেক পিঠা বিক্রি করেন ফেসবুক পেজ ”জান্নাত’স কিচেন”-এর মাধ্যমে। আত্মীয়-স্বজনের হাত ধরে ১০/১২ টি দেশে তার পিঠা গেছে। এর মধ্যে লন্ডন ছাড়াও আছে আমেরিকা, ইটালি, কানাডা , সৌদি আরব, দুবাই, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানি।

জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, “ব্যবসার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিদিনই গড়ে ৫/৬টা অর্ডার থাকে। এমনও কিছুদিন আছে আমি ২০ থেকে ২২টা অর্ডার ডেলিভারি করে থাকি। এ পর্যন্ত অনলাইনে প্রায় ১৩ লাখ টাকার পিঠা বিক্রি করেছি।”

প্রায় ১২০ রকমের পিঠা নিয়ে কাজ করেন তিনি। এর মধ্য উল্লেখযোগ্য: নকশী, সতীন মোচর, বস্তা পিঠা, সাগুদানা রিং, ফুলঝুরি, পোয়া, পানতোয়া, বকুল, দুধগকুল, রসমঞ্জরি, পাটিসাপটা, ভাপা, ঝিনুক, আস্কে, ছিটা পিঠা, শিলা পিঠা, বৌ পিঠা, জামাই আদর পিঠা, মুগপাকন, রসপাকন, ঝিলিমিলি, লবঙ্গ লতিকা, তালের পিঠা, তেলের পিঠা, ইলিশ পিঠা, বিবিখানা, আনদুশা, দুধপুলি, ভাজাপুলি, টুই, কলা পিঠা, শেয়ই, মেরা, মসলা পিঠা, মকসামালা, হৃদয়হরণ, ছানাপোরা, ঝুড়ি পিঠা, পাতা পিঠা, পাতা বেণী, চন্দ্রপুলি, চন্দ্রক্রান্তি, পাককাস, ছাঁচের পিঠা, রং বাহারি পুলি, সুজির মনডা, খেজুর পিঠা, বেণী পিঠা, চিতই, ডিমসুন্দরী, সূর্যমুখি এবং নারকেলের ছাইয়া পিঠা। এছাড়াও বিভিন্ন রকম নাড়ু , বরফি, মোরব্বা আর ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই বানান তিনি ।

জান্নাতুল জানান, তার পিঠাগুলোর সর্বনিম্ন দাম ২০ টাকা পিস আর সর্বোচ্চ ৮০ টাকা। কিছু পিঠা আছে যেগুলো কেজি দরে বিক্রি হয়। সেগুলোর দাম কেজিপ্রতি ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকা। পিঠাগুলো তিনি ব্যক্তিগত ডেলিভারিম্যানের মাধ্যমে ঢাকা শহরে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। কিছুক্ষেত্রে বা ঢাকার বাইরে কুরিয়ার সার্ভিসের সাহায্য নিয়ে থাকেন এই উদ্যোক্তা।

“নিজের ইচ্ছাটা প্রবল ছিল, তারপর ছেলের সাপোর্ট আর বোনদের উৎসাহে এগিয়ে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু অনেক বাধারও সম্মুখীন হয়েছি। আশেপাশের কিছু মানুষ কানাঘুঁষা করছিল, এত শিক্ষিত দেশে কি কাজের অভাব পড়েছে যে পিঠা নিয়ে ব্যবসা করতে হবে! রাস্তার পাশে ফুটপাতে বাজারে/স্কুল-কলেজের সামনেও তো মানুষ পিঠা বানায়। কিন্তু এই সব কথা বা বাধা আমার পথ চলাতে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি,” উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন কাজই ছোট নয়। সততা ও নিষ্ঠার সাথে কঠোর পরিশ্রম করলে যে কোন কাজেই সফল হওয়া যায়।

তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য তিনি বলেন: একটাই কথা, হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করা যাবে না। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে কোন কাজটাতে আমি সবচেয়ে দক্ষ এবং সেই দক্ষতাটাকেই কাজে লাগাতে হবে। একদিনেই হতাশ হলে চলবে না, ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে।

ভবিষ্যতে পরিকল্পনা নিয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, তিনি একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলতে চান যেখান থেকে প্রতিবছর কিছু সংখ্যক পিঠাশিল্পী বের হয়ে আসবেন। আর কিছু মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে।

আফসানা অভি
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here