A দিয়ে শুরু z দিয়ে নাম শেষ

0

অ্যামাজন ডট কম। বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেট প্লেস। অ্যামাজনের মুখ্য নির্বাহী ও প্রতিষ্ঠাতা জেফরি প্রিস্টন বেজোস বা জেফ বেজোসকে ই-কমার্স এর পথিকৃত বলা হয়। ব্যক্তিগত জীবনের চড়াই উৎরাই তো ছিলই সাথে ছিল কর্মজীবনে সফল হয়ে ওঠার পথে একের পর এক বাধা। সেইসব বাধাকে অতিক্রম করে একজন সাধারণ উদ্যোক্তা থেকে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হলেন জেফ বেজোস।

ইলন মাস্কের পর পৃথিবীর বুকে তৃতীয় ধনী ব্যক্তি হিসেবে রাজত্ব করছেন জেফ বেজোস।যদিও ইলন মাস্কের আগে পৃথিবীর প্রথম ধনী ব্যক্তির খেতাব জিতেছিলেন জেফ বেজোস। (সোর্সঃ শীর্ষ ধনীর তালিকা)

টানা আঠারো বছর পৃথিবীর শীর্ষ ধনীর অবস্থান ধরে রাখা বিল গেটসকে টপকে ২০১৮ সালে জেফ বেজোস দখল করে নিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ ধনীর খেতাব। জেফ বেজোসের রাজকীয় উত্থানের গল্প অনেকেরই জানা নেই। ওয়াল স্ট্রিটের চাকরি থেকে বই বিক্রেতা- হরেক পেশায় হরেক প্রচেষ্টায় তাঁর আজকের কিংবদন্তী হয়ে ওঠার পথে গল্প রয়েছে অনেক। তেমনই কিছু গল্প নিয়ে এই লেখাটি।

জেফ বেজোস খ্যাতিমান হয়েছেন আমাজনের (Amazon.com) প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। আজকের এই অনলাইন শপিং পদ্ধতির জনক তিনিই। তিনিই প্রথম অন্তর্জালে কেনাকাটা চালু করেন আমাজন প্রতিষ্ঠা করে। আমাজন মূলত একটি ই-কমার্স ভিত্তিক ওয়েবসাইট হলেও এটি তৈরি করা হয়েছিল একটি অনলাইন বুকশপ হিসেবে।
জেফ বেজোস ১৯৬৪ সালের ১২ জানুয়ারি আমেরিকার নিউ মেক্সিকোতে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ ছাত্র ছিলেন জেফ বেজোস। মিয়ামি পল মেট্রো হাই স্কুলে তার পড়ালেখা। জেফ বেজোস ফোর্থ স্ট্যান্ডার্ড এ পড়ার সময় তার প্রথম কোম্পানি তৈরি করেন ড্রীম ইনস্টিটিউট নামে যা কোম্পানি এডুকেশনাল সামার ক্যাম্প পরিচালনা করত।অসাধারণ প্রতিভার জন্য স্কুলে থাকাকালীন তিনি star lex s ও Silver night মেডেল অর্জন করেন।পরবর্তীতে তাকে মহাকাশ গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে সুযোগ দেয়া হয় সেখানেও তিনি তার মেধার জোরে সফলতা অর্জনে পিছ পা হননি। হাইস্কুলের গ্রাজুয়েশন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তিনি এমন এক অনাগত সময়কে দেখতে পাচ্ছেন – যখন মানুষ মহাশূন্যে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করবে। পরবর্তীতে নামকরা প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি তে এডমিশন নেন সেখানে তিনি ডিগ্রী অর্জন করেন কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর উপরে। ১৯৮৬ সালে থেকে কম্পিউটার সাইন্স ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ সেরা ফলাফল করে বের হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করার পর ওয়াল স্ট্রিটের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তিনি – যার মধ্যে ফিটেল, এবং ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম “D.E.Shaw” উল্লেখযোগ্য। D.E.Shaw তে কাজ করতে গিয়ে জেফ অসাধারন সাফল্যের দেখা পান। ১৯৯০ সালে তিনি ফার্মের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদন্নোতি লাভ করেন।

বেজোসের বয়স যখন ৩০, সিদ্ধান্ত নিলেন, চাকরি নয়, নিজেই কিছু একটা করবেন। চলে গেলেন আমেরিকার পশ্চিম প্রান্তের শহর সিয়াটলে। তার নিজের জমানো কিছু টাকা, আর পরিবারের কিছু সাহায্য – সব মিলিয়ে এক লাখ ডলারের কিছু বেশি অর্থ, এই ছিল তার বিনিয়োগ। ফিন্যান্সে একটি দারুন ক্যারিয়ার গড়ে তোলার পরও বেজোস ই-কমার্সে বিনিয়োগ করার ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। তার সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ১৭৪ বিলিয়ন বা ১৭ হাজার কোটি ডলার।
বেজোস তার গ্যারেজে অল্প কয়েকজন কর্মী নিয়ে তাঁর নতুন কোম্পানীর জন্য সফটওয়্যার তৈরীর কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁরা দুই বেডরুমের একটি এ্যাপার্টমেন্টে কাজ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে একটি পরীক্ষামূলক ওয়েবসাইট চালু করেন। ১৯৯৫ সালের ১৬ই জুলাই ৩০০ জন বন্ধুকে বেটা টেস্টিং এর জন্য ডেকে সাইট উদ্বোধন করেন।

শুরুতে অ্যামাজনের নাম ছিল ‘কাডাবরা’। ক্যাডাবরা নামটির পর বেজোস ‘রেলেন্টলেস’ নামটির কথা বিবেচনা করেন। এখনো relentless.com লিখলে আমাজনে নিয়ে যাবে। কিন্তু এ নামও বাদ হয়ে যায়। পরবর্তীতে জেফ তার ল’ইয়ারের পরামর্শে নামটি পরিবর্তন করে দক্ষিন আমেরিকার বহুশাখা বিশিষ্ট নদী আমাজন এর নামে অ্যামাজন নামকরণ করেন। এর কারণ হচ্ছে অ্যামাজন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী এবং জেফ বেজোস চাচ্ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বুকস্টোর প্রতিষ্ঠা করতে। এছাড়া Amazon ইংরেজি বর্ণমালার a দিয়ে শুরু হয় এবং z দিয়ে শেষ হয়। অর্থাৎ অ্যামাজনে এ টু জেড সবই পাওয়া যাবে এই লক্ষ্য নিয়েই শুরু করেছিলেন জেফ বেজোস।

তিনি যা আশা করেছিলেন, কোম্পানীর প্রাথমিক সাফল্য তারচেয়ে অনেক ভালো ছিলো। পত্রপত্রিকায় কোনও রকম বিজ্ঞাপন দেয়া ছাড়াই প্রথম ৩০ দিনেই আমাজন আমেরিকা সহ আরও ৪৫টি দেশে বই বিক্রী করে ফেলে। দুই মাসের মধ্যেই আমাজনের সাপ্তাহিক বিক্রয়ের পরিমান ২০,০০০ ডলারে পৌঁছায়। জেফ বেজোস ও তাঁর টিম নিজেরাও এত কম সময়ে এতটা সাফল্য আশা করেননি। ১৯৯৭ সালে আমাজন বেটা টেস্টিং শেষ করে পাকাপাকি ভাবে ব্যবসা শুরু করে। অ্যামাজন পণ্য বিক্রির জন্য ফ্রি শিপিং সুবিধা দেয়। হু হু করে বাড়তে থাকে অ্যামাজনের ব্যবসা।
এক মাসের মধ্যে অ্যামাজন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের সবগুলোতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ৪৫টি দেশে অর্ডার পাঠালো। পাঁচ বছর পর অ্যামাজনের ক্রেতার এ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়ালো ১ কোটি ৭০ লাখে। বিক্রি শুরুতে ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ডলার, আর পাঁচ বছর পর তা দাঁড়ালো ১৬০ কোটি ডলারে। বড় বড় কোম্পানি আমাজনের দরজায় ছুটে আসতে শুরু করলো। ১৯৯৭ সালে অ্যামাজন পাবলিক কোম্পানিতে পরিণত হলো, আর অর্থ উঠলো ৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ১৯৯৮ সালে বেজোস তার প্রতিষ্ঠানের সেবা শুধু বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে সিডি ও ভিডিও টেপ বিক্রি শুরু করলেন। তারপর বড় বড় খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির মধ্য দিয়ে একে একে পোশাক, ইলেক্ট্রনিক্স, খেলনা ও অন্যান্য পণ্যও যোগ হয়।
বয়স ৩৫ হবার আগেই মি. বেজোস হয়ে গেলেন পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের একজন। ১৯৯৯ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাকে আখ্যা দিলো ‘কিং অব সাইবার-কমার্স’ আর মনোনীত করলো পৃথিবীর সবচেয়ে কমবয়স্ক ‘পিপল অব দি ইয়ারের’ একজন হিসেবে।
২০০৬ সালে আমাজন ডট কম পন্য বিক্রয়ের পাশাপাশি তাদের “Video on Demand” সার্ভিস চালু করে, যার প্রাথমিক নাম ছিল “Amazon Unbox” – পরবর্তীতে যা “Amazon instant Video” নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
২০০৭ সালে আমাজন তাদের ডিজিটাল বই পড়ার একটি স্মার্ট ডিভাইস “Kindle” বাজারে ছাড়ে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা বই পড়ার পাশাপাশি বই কেনা, ডাউনলোড, ও স্টোর করার সুবিধা পেতেন।
মাত্র দু’দশক আগেও তিনি ছিলেন সাধারণ এক উদ্যোক্তা। কিন্তু তিনি দেখতে পেয়েছিলেন এমন এক যুগ আসছে – যখন কম্পিউটারের এক ক্লিকে যে কোন জিনিস কেনা যাবে, শপিং মলের জনপ্রিয়তা কমে যাবে, দোকানগুলো ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য নানা রকমের ‘অফার’ দিতে বাধ্য হবে।
২০১৩ সালের আগস্টে বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের সব প্রকাশনা কিনে নিয়ে পৃথিবীর প্রায় সব বড় নিউজ এজেন্সির খবরের শিরোনামে উঠে আসেন বেজোস। প্রতিষ্ঠানটি কিনতে তিনি ২৫ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করে বাংলা টাকায় যার মূল্য ২১০০ কোটি টাকা!

মাত্র ২১ জন কর্মচারী নিয়ে অ্যামাজনের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। বর্তমানে অ্যামাজনে চাকরি করেন ৫ লাখ ৭৫ হাজার লোক যা ইউরোপের দেশ লুক্সেমবার্গের জনসংখ্যার প্রায় সমান।
জেফ বেজোসের কৌশল ছিল, তিনি অর্থ আয় করার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পিছপা হন নি।
অ্যামাজনে পণ্য বিক্রির জন্য তিনি ফ্রি শিপিং সুবিধা দিয়েছেন, দাম কম রেখেছেন ২৩ বছরের মধ্যে ১০ বছর ধরে – বার্ষিক লাভের কথা না ভেবে। কিন্ডল ই-বুক রিডারের মতো যন্ত্র তৈরির জন্য বছরের পর বছর সময় ব্যয় করেছেন। অন্যদিকে আবার অ্যামাজন যেখানে যেভাবে সম্ভব – টাকা বাঁচিয়েছেও। অ্যামাজনের হেড অফিসে কর্মীদের গাড়ি পার্ক করার জন্য পয়সা দিতে হয়েছে।
আমাজনে যারা পণ্য বিক্রি করেন তাদের জন্য পণ্য আনা নেয়া, ঋণ, বিক্রির প্ল্যাটফর্ম দেয়া হচ্ছে, পাশাপাশি এর ‘ক্লাউড কম্পিউটিং বিভাগ’ অসংখ্য বড় বড় কোম্পানির জন্য অনলাইন ডেটা স্টোরেজ সুবিধা দিচ্ছে – যা এখন পৃথিবীর বৃহত্তম।

বেজোস সবকিছুতেই অভিনব সব কর্মপন্থা অবলম্বন করেন। যেমন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং, কোটি কোটি ডলারের লেনদেন- সবই হবে ‘দুই পিজ্জা নীতি’তে (Two Pizza Rule by Jeff Bezos)! বেজোস দুটি পিজ্জা অর্ডার দিবেন, এবং সেগুলো খেতে খেতে মিটিং হবে। কিন্তু মানুষ তো অনেক, দুটি পিজ্জায় কি সবার হবে?
এখানেই মজা, বেজোসের নীতি হচ্ছে দুটি পিজ্জা খাওয়ার পরিমাণ মানুষ নিয়েই মিটিং হবে। খুব অল্প কয়জন থাকবে। স্যুট-টাই পরা কর্পোরেট ভারিক্কি কথাবার্তা চলবে না। একদম গল্পচ্ছলে আগাবে কাজ। তিনি বিশ্বাস করেন ছোট টিম অনেক বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে।
বেজোসকে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনি পৃথিবীর শীর্ষ ধনীদের একজন, অসম্ভব ক্ষমতাধর একজন মানুষ। আপনার মুখের উপর কেউ না বলার সাহস করে আমাজনে?’
জেফ বেজোস হেসে বললেন, ‘না বলতে পারে না এমন কারো নামই তো মাথায় আসছে না!’
আমাজনের পরিবেশটিই এমন। আমাদের দেশে যেমন ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট!’ নীতি চলে, আমাজনে কখনোই এমন চলে না। একজন পিয়নও গিয়ে বেজোসকে বলতে পারে, ‘মি. বেজোস, আমার মনে হয় অমুক কাজটি এভাবে করলে আরো ভাল হতে পারে।’ সেখানে কোন ইগো নেই, খবরদারি দেখানোর মানসিকতা নেই।
কাজের আনন্দ, সবার মাঝে বন্ধন, আর ক্রেতাকে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার মানসিকতাই জেফ বেজোসকে করে তুলেছে পৃথিবীর শীর্ষ ধনী ব্যক্তি। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজোসের দিকে তাকাই, তিনি নিজেই কিন্তু ‘কথা কম, কাজ বেশি’ নীতিতে বিশ্বাসী। শুধু তাই’ই নয়, বলা চলে মিটিং যেন তার দুই চোখের বিষ। বিনা প্রয়োজনে কখনও কোন মিটিংয়ে যান না তিনি। পরিবারকে সময় দেবেন বলে সকালবেলাও কোন মিটিং রাখেন না।

২০১৮ এর জানুয়ারিতে ব্লুমবার্গের হিসেব মতে তাঁর মোট সম্পদের পরিমান গননা করা হয় ১১৮.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার – অর্থাৎ প্রায় এগারো হাজার দুইশো কোটি মার্কিন ডলার । তাঁর আগে পৃথিবীর ইতিহাসে হাতে গোণা কয়েকজন মানুষ এত সম্পদের মালিক হতে পেরেছেন।
৩০ বছরে পদার্পণ করলো বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান আমাজন। ১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই উদ্যোক্তা জেফ বেজোসের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here