স্পর্শ হায়দার একজন উদ্যোক্তা। ‘টেলস অফ নকশী’র স্বত্ত্বাধিকারী । সিদ্ধেশ্বরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়ালেখা করছেন স্পর্শ।
ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল স্বাধীনভাবে নিজে কিছু করার। এ ইচ্ছা থেকে টিউশন করে যতোটা পেরেছেন নিজের খরচ নিজে চালিয়েছেন। বাবা-মা বা পরিবার থেকে হাতখরচ নেওয়া তার কখনোই পছন্দ ছিল না। সবসময় ভেবেছেন পড়াশোনার পাশাপাশি এমন কিছু একটা করতে হবে যেন কাজ ও লেখাপড়া দুটোই ঠিকমতো চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।
ইচ্ছা ছিল আইনজীবি বা ব্যবসায়ী হবেন। ২০১৮ সালে হঠাৎ বাবার মৃত্যুর পর সিদ্ধান্ত নেন তাকে দ্রুত কিছু একটা শুরু করতে হবে। তার মনে হয়েছে হাতে সময় খুব কম, যতো আগে শুরু করতে পারবেন ততোই বাস্তব থেকে বেশি শিখবেন এবং এগিয়ে থাকবেন।
তিনি মনে করেন ক্যারিয়ার বা উদ্যোগ যেকোন ক্ষেত্রে সময় একটা বড় ব্যাপার । পরে অনেক চেষ্টা করলেও সময় তো আর ফেরত আসবে না। আগামীর এই ৫/৬টা বছর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে ব্যবসাটাই হতে পারে সবচেয়ে ভালো অপশন।
কী নিয়ে ব্যবসা করবেন সেজন্য অনেক রিসার্চ, বাজার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান, সর্বোপরি মুলধন দরকার। লন্ডন থেকে ফুফাতো বোন জানালেন জামদানি বা নকশী নিয়ে কাজ করলে ভালো সাড়া মিলতে পারে। দেশে তো বটেই, গোটা পৃথিবী জুড়েই এর প্রচুর চাহিদা আছে। আর এই দুই শিল্প বাঙালির ঐতিহ্য।
কিন্তু তিনি মনে করেন যেকোন বিষয়ে কাজ করতে গেলে নিজেরও ওই বিষয়ে জ্ঞান রাখা প্রয়োজন। ফুফাতো বোনের যেহেতু বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, সুতোর কাউন্ট, কালার কম্বিনেশন সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল, তাই তিনি সবসময় পাশে থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। উদ্যোক্তা স্পর্শ হায়দারের ব্যক্তিগতভাবে শাড়ি খুব পছন্দ। তার মনে হলো, এই পোশাককে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে দুটো শিল্পকে নিয়ে তিনি শুরু করতে পারেন। তখন তার বোন বললেন, নকশী কাজটা যেহেতু শুধুমাত্র মেয়েরাই করে, তাহলে এই নকশী নিয়েই কিছু করা প্রয়োজন। তিনিও ভাবলেন: সত্যিই তো! নারীরা কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন।
এই চিন্তাকে পূঁজি করে প্রায় ছয়মাস ধরে প্রোডাক্টের গুণগত মান, চাহিদা, উপযুক্ত বাজার মূল্য, মুনাফা, কীভাবে করলে বাজারে থাকা পণ্য থেকে তারটা একটু অন্যরকম হবে– এসব নিয়ে অনেক হোমওয়ার্ক করেন।
পরে তার ওই বোন পূঁজির ব্যাপারেও সহযোগিতা করেন। কম পুঁজিতে সারাবিশ্বের মানুষের কাছে সহজে পৌঁছাতে গেলে অনলাইন মাধ্যমটাই ভালো হবে চিন্তা করে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ শুরু করলেন অনলাইন পেজ। সংগ্রহ করলেন নিজের মতো করে করানো ২০ টা শাড়ি। পূঁজি ছিল ৫০ হাজার টাকা।
অনলাইনে উদ্যোগ নেওয়ার পর প্রথমেই যে বাধা এসেছে তা হলো তাকে কেউ তখন জানে না চেনে না। অনলাইনে না দেখে শুধুমাত্র কথার উপর নির্ভর করে বড় বাজেটের একটি পণ্য কীভাবে ক্রেতা কিনতে ভরসা করবেন? শুধুমাত্র হাতের কাজের পিওর সিল্ক শাড়ি নিয়ে খুব অল্প সংখ্যক পেজ ওনার ছিলেন ওই সময়। পিওর সিল্ক সবাই হাতে ধরে যাচাই করে অফলাইনে কিনেই অভ্যস্ত তখন পর্যন্ত । বাধ্য হয়ে তিনি একটি অপশন তখন রেখেছিলেন, ছবির থেকে সামনে যদি প্রোডাক্ট সুন্দর কম মনে হয় তাহলে ডেলিভারির সময় ফেরত দিতে পারবেন ক্রেতা।
তারপরও তাকে প্রায় দুই মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে অনলাইনে প্রথম অর্ডারের জন্য। তবে এখন প্রচুর রিপিট কাস্টমার তার। ক্রেতারা পণ্য হাতে পাওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
অল্প সময়েই ক্রেতারা তাকে অনেক বিশ্বাস করেছেন। প্রথম ৬/৭ মাস তিনি নিজে ডোর টু ডোর ডেলিভারি দিয়েছেন। ওই সময়টা অনেক ধৈর্য্য ধরে মাটি কামড়ে থাকতে হয়েছে তাকে।
এখন পুরো বাংলাদেশের সব জেলাতেই তার পণ্য যায়। পাশাপাশি লন্ডন, ইটালি, ফ্রান্স, আমেরিকা, কানাডা এসব দেশে তার অনেক রিপিট কাস্টমার আছে। তিনি জানান মাসে সবরকম পণ্য মিলিয়ে প্রায় ৩০ পিস সেল হচ্ছে।
উদ্যোক্তা জীবনে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন তার ফুফাতো বোনদের। স্পর্শ বলেন, “মেজ ফুপি, খালা, চাচী সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই কাজটা আমার প্যাশন, এটা আমার ভালো লাগার জায়গা। বলতে পারেন আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখি এই কাজ করছি। তাই সবার সাপোর্ট-সাজেশন যখন পাই, ভালো লাগাটা ভালোবাসায় পরিণত হয়, মনে সাহস আসে।”
ভবিষ্যত পরিকল্পনায় এই নারী উদ্যোক্তা শুধুমাত্র হাতের কাজের শাড়ির উপর একটি বড় আকারের স্টুডিও করতে চান যেখানে তিনি ক্রেতার মনমতো কাস্টোমাইজড হাতের কাজের শাড়িই শুধু করাবেন। কাস্টোমাইজড কাজ এখন খুব কম হয়। তাই এই কনসেপ্টে বড় পরিসরে কাজ করতে পারলে অনেক নারীকেও এই কাজে যুক্ত করতে পারবেন বলে আশাবাদী স্পর্শ হায়দার।
মাসুমা শারমিন সুমি,
উদ্যোক্তা বার্তা