হাজারও বাধা পেরিয়ে

0

২০১৮ সালে রাজধানীর ল্যাবএইড হসপিটালের  সামনে এক বয়স্ক লোকের কাছ থেকে নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন তিনি। ওই মুহূর্তে জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেও কাউকে পাশে পাননি জিনাত জাহান নিশা। সেদিন বাসায় ফিরে রাগে-ক্ষোভে পরোক্ষ প্রতিবাদ হিসেবে নিজের খোঁপার কাঁটায় লিখেন ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ কথাটি।

নিশা শিক্ষার্থী থাকাকালীনই ভাবতেন আর যাই করুন,  চাকরি করবেন না। অন্যের জন্য শ্রম না দিয়ে নিজের জন্য শ্রম দেবেন, সেটা যতো ছোটই হোক না কেন। ছোটবেলায় অভিনয়শিল্পী হতে চেয়েছিলেন, তা না হতে পারলেও দুঃখ নেই। এখন নিজের প্রতিষ্ঠানে করছেন। সবসময় স্বাধীনভাবে কিছু করার যে ইচ্ছা, সেখান থেকে  এখন তা নেশা এবং পেশা।

উদ্যোগ শুরুর কথা জানতে চাইলে তিনি জানান: ছোটবেলা থেকেই মায়ের হাতে নকশা করা জামা পরতেন তারা। মায়ের পর বড় বোন বিজু নিজ হাতে নকশা, সেলাই করে বানিয়ে দিতেন সকলের পোশাক। মূলত বড় বোনের মাধ্যমেই এই ভাবনার বীজ বপন হয়। এই উদ্যোগের যাত্রার শুরুটা তার প্রভাবেই হয়েছে। ২০১৫ সালের মে মাসে যাত্রা শুরু করে “BJNS-বিজেন্স”।

নামের পেছনের গল্পটাও জানিয়েছেন তিনি। সেই  ৯০ দশকের শিশু-কিশোররা ঈদ, জন্মদিন বা বিভিন্ন উৎসবে নিজেদের মধ্যে কার্ড বিনিময় করতো। নিশারাও মা-কে উপহার দেওয়ার জন্য নিজেরাই নানারকম কার্ড বানাতো। একবার শহরতলির এক গিফটশপের দোকান মালিকের আগ্রহে নিজেদের বানানো ঈদ কার্ড বিক্রির জন্য দেন তারা। বড় বোন বিজু সবার নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে কার্ডের পেছনে লিখে দেন BJNS (Biju, Jisha, Nisha, Shuvo) অর্থাৎ ‘বিজেন্স’। সেই থেকেই স্বপ্নের যাত্রা শুরু। সেই হিসেবে ছোটবেলার সেই কার্ডগুলোই ‘বিজেন্স’-এর প্রথম পণ্য। উদ্যোগ শুরু হলে ফেইসবুকে এই নামেই খোলা হয় পেইজ।

এই অদম্য উদ্যোগে মূলধন বলতে নিজেদের সংগ্রহে থাকা পু্তি, পেন্ডেন্ট, সুতো দিয়েই আবার নতুন করে গয়না বানিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। চার ভাইবোন মিলে নিজেরাই বানাতেন সেই গয়না। মূলত গয়না দিয়েই ‘বিজেন্স’-এর আত্মপ্রকাশ।

উদ্যোক্তা জিনাত জাহান নিশা পড়াশোনা করেছেন চারুকলা বিষয়ে। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের চারুকলা অনুষদের পেইন্টিং বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন। সবার বড় বোন বিজু পড়াশোনা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে। মেজো বোন জিসা নাট্যতত্ত্ব বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ছোট ভাই শুভর পড়াশোনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে, তিতুমীর কলেজে।

গয়না দিয়ে ‘বিজেন্স’-এর যাত্রা শুরু হলেও চার ভাই বোন চার ডিপার্টমেন্টের হওয়ায় প্রতিটি ডিজাইনে আসে ভিন্ন ধারা; ব্যতিক্রমী নকশা পোশাকে, গয়নায়। নারী, পুরুষ, শিশু সবার জন্য পোশাক, গয়নায় নতুন নতুন নকশা করেন তারা।

জামা-কাপড়, গয়নাকে শুধু ফ্যাশন হিসেবেই নয়; প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও তারা বেছে নিয়েছেন। আংটিতে ‘থামুন’, খোপার কাঁটায় ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দো কেন?’, টিশার্টে ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’, শাড়ির আঁচলে ‘সুবোধ যদি পালিয়ে যায় তাহলে ভোর আনবে কে?’- এ ধরনের নানান বার্তায় প্রতিনিয়ত ফ্যাশনের রাজ্যে নিয়ে এসেছেন এক নতুন মাত্রা।

ব্যবসাকে তারা শুধু অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না। সামাজিক দায়বদ্ধতাও ভাবায় তাদের। তারা তাদের মতো করে এখানে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। ভাবেন ‘বিজেন্স’ খুব ছোট এখনও। তবুও তাদের কাজ দিয়ে বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেন নানা সামাজিক কুপ্রথা, বিকৃত মানসিকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে। এটা শুরু থেকেই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। দেশের নানা দুর্যোগে ‘বিজেন্স’ তার সীমিত সাধ্য থেকে আর্তদের পাশে থাকার চেষ্টাও সবসময় করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে বলে নিশা জানান।

‘বিজেন্স’-কে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ বাধা প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে। কাঁচামাল বা ম্যাটেরিয়াল সোর্সিং অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। কাঁচামাল সংগ্রহে দেখা গেছে পরিচিত অনেকেই ছিলেন তাদের থেকে অনায়াসে সাহায্য পেতে পারতেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু বরাবরই তাদের জেদ ছিল যা যা করতে হবে, সব নিজে ঘুরে, ঘেঁটে বের করবেন। এভাবে কাজ করলে একটা আত্মতৃপ্তি আসে। দিন শেষে এই তৃপ্তিটাই এনে দেয় মধুর প্রশান্তি। কাজের প্রতিটি পরতেই কোন না কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল। পথটা এখন একটু মসৃণ হতে শুরু করেছে, তবে তা তৈরি করতে অনেক স্ট্রাগল করতে হয়েছে। ঝুঁকি, বন্ধুরপথ পার হতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। একদম আরামসে কোন লক্ষ্যে আসলে পৌঁছাতেও চান না তারা। পরিশ্রম করে সাফল্য পেতেই ভালোবাসেন।

‘বিজেন্স’ এর ভিন্নধর্মী নকশা, ব্যতিক্রমী ভাবনা এটা স্বাচ্ছন্দ্যে গ্রহণ করছেন গ্রাহকেরা, জানাচ্ছেন আত্মতৃপ্তির কথা, দিচ্ছেন উৎসাহ। ‘বিজেন্স’ এর নকশা, নকশার ভাবনা গ্রাহকদের শক্তিশালী করছে, আত্মবিশ্বাসী করছে, করছে অনুপ্রাণিত। দেশের মাটি ছাড়িয়েও ‘বিজেন্স’ সুনাম কুড়িয়েছে বিদেশের মাটিতে। বাংলাদেশের সব জায়গাতে এর পণ্য যায়। এছাড়া ভারত, ইউএসএ, ইউকে, অস্ট্রেলিয়াতেও যাচ্ছে। গ্রাহকদের এই সন্তুষ্টি দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন তারা, পাচ্ছেন আত্মতৃপ্তি।

নিশা জানান: আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একজন উদ্যোক্তা হওয়ার গ্রহণযোগ্য পথ অনেক। ই-উদ্যোক্তা বা এফ-উদ্যোক্তা হওয়ার সুবিধা হলো সহজেই শুরু করা যায়। খুব বেশি মূলধন ছাড়াই শুরু করা যায়। তবে শুরু করা যতোটা সহজ, ততোটাই কঠিন ধরে রাখা বা টিকে থাকা।

চার ভাই বোনের যৌথ প্রচেষ্টায় শুরু হলেও এখন সক্রিয়ভাবে ‘বিজেন্স’ নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবছেন সাতজনের একটি টিম। এছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছেন ২৫ জনের বেশি একটা দল।

একজন সফল উদ্যোক্তার গুণাগুণ সম্পর্কে তিনি বলেন:
প্রায় ২৪ ঘন্টাই একটি উদ্যোগ কোন না কোন ভাবে সক্রিয় থাকে। যতটা সহজ মনে হয় ততটা সহজ নয় এই পুরো বিষয়টি৷ তবে কাজ শুধু করে গেলেই চলবে না; পরিশ্রম, সততার সাথে হুবহু অনুকরণ প্রবণতা থেকে বের হয়ে এসে নিজস্বতা বজায় রেখে কাজ করা উচিত। সততা, পরিশ্রম, ডেডিকেশন, ধৈর্য এবং সততা রেখে, অতিরিক্ত অহংকার বা আত্মতুষ্টি থেকে দূরে থেকে, গ্লোবাল কপিরাইট এথিকস, এথিক্যাল ব্যাপারগুলো মাথায় রেখে কাজ করলে নিজের প্রতি নিজের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়বে, তেমনি সফলতাও আসবে।

হাবিবুর রহমান
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here