উপযুক্ত বিনিয়োগ পরিবেশ এবং সরকারের আর্থিক ও নীতিগত সহায়তার সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা কিংবা উৎপাদন ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত হয়ে নারী উদ্যোক্তারা গড়ে তুলছেন শিল্প-কারখানা। কর্মসংস্থান তৈরিতেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
সরকারি উদ্যোগে ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে ব্যবসা পরিচালনার আনুষঙ্গিক কার্যক্রম অনেক সহজ করা হয়েছে। নারীরা এক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। সেই সুযোগে তারা হয়ে উঠছেন উদ্যোক্তা। গত এক দশকে দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। বর্তমানে দেশে প্রতিবছর যতজন উদ্যোক্তা হচ্ছেন তার মধ্যে ৩২ শতাংশই নারী। এছাড়া করোনা মহামারির মধ্যে অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে আছেন।
নারী উদ্যোক্তারা চাইলে জামানতবিহনী ঋণ নিতে পারছেন। যেহেতু নারীদের পক্ষে জামানত দেওয়া কঠিন কাজ, সেই বিবেচনায় সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে নারী উদ্যোক্তাদের তুলনামূলক কম সুদে জামানতবিহীন ঋণ দিচ্ছে।
এসএমই ফাউন্ডেশন বিদায়ী (২০২১-২২) অর্থবছরে মোট ২০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, যার মধ্যে ৩০ শতাংশ বা ৬০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে নারী উদ্যোক্তাদের। এখান থেকে একজন উদ্যোক্তা ১ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারছেন। এর মধ্যে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য কোন জামানত দিতে হয় না।
বাংলাদেশ ব্যাংক সার্বিকভাবে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণদানের ক্ষেত্রে সুদের হার কমিয়েছে। প্রচলিত ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও নারী উদ্যোক্তারা ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পান। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘স্মল এন্টারপ্রাইজ খাতে পুনঃঅর্থায়ন স্কিম’ এর আওতায় স্বল্প সুদে ঋণ পাচ্ছেন নারীরা। ২০২৪ সালের মধ্যে এই খাতে প্রদত্ত ঋণের অন্তত ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)এর চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা অত্যন্ত সৃজনশীল ক্ষমতার অধিকারী। তারা যেকোন কঠিন কাজও দেখে দেখে শিখে নিতে পারেন। তবে, তাদের অর্থায়ন প্রাপ্তি আরও সহজ করা যেতে পারে। তিনি বলেন, সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যেসব নীতি সহায়তা দিয়েছেন, সে সম্পর্কে নারী উদ্যোক্তাদের অনেকেই অবহিত নন। এ বিষয়ে নারী উদ্যোক্তাদের অবহিত করতে আরও উদ্যোগী হওয়ার দরকার।
তিনি জানান, পিকেএসএফ প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। পিকেএসএফ’র ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ গ্রহণের জন্য কোন জামানত দিতে হয় না। তবে, পিকেএসএফ এর ঋণদান পদ্ধতিতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
মহামারি করোনার মাঝেও অনেক নারী উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে নারীরা ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সামাজিক মাধ্যমে ব্যবসা চালাচ্ছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে ফেসবুক পেজ খুলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রি করছেন নিজের প্রতিষ্ঠানের পণ্য। চলমান করোনার মধ্যে অনলাইনভিত্তিক নারী উদ্যোক্তা অনেক সৃষ্টি হয়েছে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) তথ্য মতে, এখন দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে নারীরা স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন। ই-ক্যাবের তথ্যমতে, গত এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঈদসহ যেকোন উৎসবে এ লেনদেন বাড়ে।
নারী উদ্যোক্তাদের কেউ পোশাক, কেউ গয়না, কেউ হাতে তৈরি নানা জিনিস, কেউ তৈরি খাবারসহ নানা পণ্য বিক্রি করছেন। অনেকে দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজ করছেন। কেউ শৌখিন পণ্য নিয়ে ব্যবসায় নেমেছেন। এই নারীরা শিক্ষিত। সংসারের চাপসহ নানা সমস্যায় অনেকের পক্ষে চাকরি করা সম্ভব হয়নি। অনেকে নিজে কিছু করবেন বলে বদ্ধপরিকর। ফলে, সংসার সামলানোর পাশাপাশি স্বাধীন এ ব্যবসায় আগ্রহ বাড়ছে নারীদের।
সফল নারী উদ্যোক্তা নাদিয়া বিনতে আমিন নিজের ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি দীর্ঘদিন নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষস্থানীয় সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) পরিচালক।
তিনি মনে করেন, অর্থায়ন নারীর ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় বাধা। অবশ্য বর্তমান সরকার উদ্যোক্তাবান্ধব হওয়ায় এ সমস্যার অনেক কমেছে। নারীদের এগিয়ে নিতে অনেক কাজ করছে সরকার। তরুণ ও নারী উদ্যোক্তারা যাতে সহজে ঋণ পেতে পারেন, সেজন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশনসহ অন্য ঋণদানকারী সংস্থা। তবে, ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করা দরকার বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা