বাংলাদেশের শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে চলেছে। বিরাট সংখ্যক নারী অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি ধরনের আয়মূলক উদ্যোগ পরিচালনা করছেন। নিজস্ব উদ্যোগ পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হয়। এর ওপর বিরাট সংখ্যক নারী কোভিড অতিমারীতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অতিমারীর ক্ষতি কাটিয়ে উঠে নারীরা যাতে আবার নিজেদের উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সেজন্য ভিসা ফাউন্ডেশনের সহায়তায় একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে কিছু সুপারিশ করেছে ব্র্যাক। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে নারীদের দ্বারা পরিচালিত অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি ধরনের আয়মূলক উদ্যোগ টেকসইভাবে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে আয়োজিত “নীতি বিষয়ক জাতীয় সংলাপ: নারী উদ্যোক্তাদের জন্য অর্থায়নে প্রবেশগম্যতা” বিষয়ক অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে পাইলট প্রকল্পটির অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং সুপারিশগুলো উত্থাপন করা হয়।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকের হোসেন, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)-এর চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান, এসএমই ফাউন্ডেশন-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান এবং জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ-এর সভাপতি মীর্জা নুরুল গনি শোভন।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য দেন শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও অভিবাসন বিষয়ক পরিচালক সাফি রহমান খান। জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিষয়ক পরিচালক নবনীতা চৌধুরী পটভূমি ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখেন। ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদ ভবিষ্যৎ নির্দেশনা বিষয়ে ও উপসংহারমূলক বক্তব্য রাখেন। এতে দুটি প্রেজেন্টেশনও দেওয়া হয়, এর একটি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ব্যবসা উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে ১,০৪০ জন নারী উদ্যোক্তার জন্য নিবিড় প্রশিক্ষণমূলক পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর এবং অপরটি ছিল প্রকল্পের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটি নীতি-সংক্ষেপ।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার মো. জাকের হোসেন বলেন, “বিভিন্ন ধরনের যে সুযোগ সুবিধা আছে তা অনেক নারী উদ্যোক্তারই জানা নেই যেটা এক্ষেত্রে একটি বড় সীমাবদ্ধতা। এসএমই খাতের অনেক নারী উদ্যোক্তা জানেন না যে ঋণ সময়মতো পরিশোধ করলে নারী ঋণগ্রহীতার জন্য ১% সুদ কমিয়ে দেওয়ার সুবিধা রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।”
বিসিক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, “বিসিকের ছয়টি প্রধান বিভাগের মধ্যে একটি বিপণন বিভাগ যা প্রতিনিয়ত নারী উদ্যোক্তাদের বিপণন সুযোগ-সুবিধা তৈরি ও বৃদ্ধিতে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের একটি কাজ হচ্ছে ই-প্ল্যাটফর্মগুলোতে নারী উদ্যোক্তাদের সুযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ।”
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মফিজুর রহমান বলেন, “অতিমারীতে ক্ষতিগ্রস্ত এ খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ সরকারের ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ এসএমই ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। আমরা অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এই প্রণোদনা বিতরণ করে দিয়েছি। আমাদের কাছে গ্রহীতাদের পূর্ণ তথ্যভাণ্ডারও আছে। ব্যাংকগুলো এখনও এই কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি।”
জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ-এর সভাপতি মীর্জা নুরুল গনি শোভন বলেন, “নারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অতিমারীতে নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা তারা পাননি।”
ব্র্যাকের পরিচালক সাফি রহমান খান বলেন, “প্রয়োজনীয় তথ্য নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি সীমাবদ্ধতা, পাশাপাশি ব্যবসা শুরুর জন্য প্রাথমিক পুঁজি ও চলমান পুঁজির অভাবও একটি বড় সমস্যা।”
ব্র্যাকের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, “পুরুষ গ্যারান্টর ছাড়া ৮০% নারী উদ্যোক্তা কোনো ঋণ পাননি, যদিও নীতিমালায় এ ধরনের কোনো শর্ত নেই। দেশের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ঋণপ্রাপ্তি সুগম করার জন্য এ সংক্রান্ত শর্তাদি শিথিল করতে হবে।”
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর সারাংশ:
১. নারী উদ্যোক্তাদের নেওয়া ঋণের জন্য চূড়ান্ত সুদহার কমিয়ে সর্বোচ্চ ৭% করা।
২. কুটিরভিত্তিক, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা ও ব্যবসার ধরন বুঝে বাস্তবসম্মতভাবে ঋণের শর্তসমূহ স্থির করা।
৩. ব্যাংক ও ক্ষুদ্র অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ও অর্থায়ন নীতিমালায় পরিবর্তন-সংযোজন আনা ।
৪. ঋণ পরিশোধে “গ্রেস পিরিয়ড”বাড়াতে বা সংযোজন করা।
৫. সরকারি প্রণোদনা ও অনুদান প্যাকেজগুলো প্রদান প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান জটিলতা দূর করা যাতে নারী উদ্যোক্তারা তা পেতে পারেন।
৬. নারী উদ্যোক্তারা যাতে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করতে পারেন সেজন্য তাদের দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা নেওয়া।
৭. নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক বীমা সুবিধা প্রদান বা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা।
৮. অতিদরিদ্র নারী উদ্যোক্তাদের সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার আওতায় আনা।
ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা