জামদানি হলো কার্পাস তুলা দিয়ে তৈরি একধরনের পরিধেয় বস্ত্র যার বয়ন পদ্ধতি অনন্য। জামদানি বুননের সময় তৃতীয় একটি সুতা দিয়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। মসলিন বয়নে যেমন কমপক্ষে ৩০০ কাউন্টের সুতা ব্যবহার করা হয়, জামদানি বয়নে সাধারণত ব্যবহার হয় ২৬-৮০-৮৪ কাউন্টের সূতা। জামদানি বিভিন্ন জায়গায় তৈরি করা হয় বটে, কিন্তু ঢাকাকেই জামদানির আদি জন্মস্থান বলে গণ্য করা হয়।
মূলত বাংলাদেশের ঢাকা জেলাতেই মসলিন চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিলো। জেলার সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি এলাকা মসলিনের জন্য ছিলো সুবিখ্যাত। ইউরোপীয়, ইরানী, আর্মেনিয়ান, মুঘল, পাঠান বণিকেরা মসলিন ও জামদানি ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে তৎকালীন শাসকেরাও এই শিল্প বিকাশে ভূমিকা রেখেছেন।
ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণযুগ বলা হয় মুঘল আমলকে। সেসময় দেশে-বিদেশে মসলিন, জামদানির চাহিদা বাড়তে থাকে এবং শিল্পেরও ব্যাপক উন্নতি হয়। আঠারো শতকে ইংরেজ দলিল থেকে জানা যায়, মলমল খাস ও সরকার-ই-আলি নামের মসলিন সংগ্রহ করার জন্য দারোগা-ই-মলমল পদবীর উচ্চ পর্যায়ের রাজ কর্মচারি নিযুক্ত ছিলেন। প্রতিটি তাঁতখানায় একটি দপ্তর ছিল এবং দক্ষ তাঁতি, নারদিয়া, রিপুকার প্রভৃতি কারিগরদের নিবন্ধন করে রাখা হতো। দারোগার প্রধান কাজ ছিলো মসলিন ও জামদানি তৈরির বিভিন্ন পদক্ষেপে লক্ষ্য রাখা। তৎকালীন সময়ে ঢাকা থেকে প্রায় এক লাখ টাকা মূল্যমানের মলমল-খাস মুঘল দরবারে রপ্তানি করা হত। ১৭৪৭ সালের হিসাব অনুযায়ী দিল্লীর সম্রাট, বাংলার নবাব ও জগৎশেঠের জন্য প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার জামদানি কেনা হয়। এছাড়া ইউরোপীয় বণিকেরা প্রায় নয় লাখ টাকার মসলিন কেনে। তবে আঠারো শতাব্দীর শেষদিকে মসলিন রপ্তানি অনেকটা কমে আসে।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি জামদানি ও মসলিনের এক হিসাব থেকে দেখা যায়, সাদা জমিনে ফুল করা কাজের ৫০,০০০ টাকার জামদানি দিল্লী, লক্ষ্মৌ, মুর্শিদাবাদ, নেপাল প্রভৃতি এলাকার নবাবরা ব্যবহার করতেন। এই শিল্প সংকুচিত এবং পরে বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে কিছু কারণ ছিলো। যার মধ্যে প্রধান কারণ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব। এর ফলে বস্ত্রশিল্পে যন্ত্রের আগমন ঘটে এবং কম দামে ছাপার কাপড় উৎপাদন শুরু হয়। এছাড়া দেশী সূতার চেয়ে তখন বিলেতি সূতার দাম কম ছিলো। তৎকালীন মুঘল সম্রাট ও তাদের রাজ কর্মচারিরা এ শিল্পের প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়েন। ফলে ধীরে ধীরে মসলিন ও জামদানি শিল্প কালের গহ্বরে হারিয়ে যায়।
তবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকার ডেমরায় জামদানি পল্লীর তাঁতিদের আর্থিক সাহায্য দেয়া হয়। বর্তমানে রূপগঞ্জের নোয়াপাড়াতে জামদানি পল্লী স্থাপিত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জামদানির চাহিদা এখনও বেশ লক্ষণীয়। বর্তমান বাজারে জামদানির উচ্চমূল্য ও বিপুল চাহিদার কারণে বাংলাদেশের এই শিল্পে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে।
জামদানির মধ্যে বেশ কিছু প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন –
হাফ সিল্ক জামদানি: যার আড়াআড়ি সুতাগুলো হয় তুলার আর লম্বালম্বি সুতাগুলো হয় রেশমের।
ফুল কটন জামদানি: যা সম্পূর্ণ তুলার সুতায় তৈরি।
ফুল সিল্ক জামদানি: যা সম্পূর্ণ রেশমের সুতায় তৈরি।
বর্তমানে জামদানি নিয়ে কাজ করছেন অনেক নতুন উদ্যোক্তা। দেশীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে জামদানি দিয়ে তৈরি হচ্ছে জুতা, হ্যান্ড পার্স, ব্যাগ, পাঞ্জাবি, পাগড়ি, শাড়িসহ আরো অনেক কিছু। নতুন উদ্যোক্তারা জামদানিকে ছড়িয়ে দিতে জামদানিকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করছেন যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও বেশ প্রশংসনীয়।
জামদানির পুনরুজ্জীবনের পথে প্রধান অন্তরায় হলো দক্ষ ও আগ্রহী তাঁতশিল্পীর অভাব। এই শ্রমনিবিড় হস্তশিল্পে উপযুক্ত মজুরি নিশ্চিত না করা গেলে তাঁতিরা আগ্রহী হবেন না। জামদানি শাড়ির আগের সব বিখ্যাত ও অবিস্মরণীয় নকশা ও বুননের অনেকগুলোই বর্তমানে বিলুপ্ত। নবীন কারিগররা বেশিরভাগ নকশা সম্পর্কে অবহিত নন। আদি জামদানির নকশা ও বুনন কৌশল নতুন প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ এই কাজটি যেমন জটিল এবং তেমনি শৈল্পিকও। বিভিন্ন ধাপে জামদানি তৈরি করা হয়:
ধাপ ১: রেশমি গুটি থেকে তৈরি সুতা মূল শাড়ি প্রস্তুতের জন্য তাঁতে সাজানো হয়।
ধাপ ২: গুটি থেকে প্রস্তুত সুতা রঙ করা হয়।
ধাপ ৩: রঙ করা সুতা বোনার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
ধাপ ৪: সুতাকে শক্ত করার জন্য কয়েক ধাপে ভাতের মাড় দিয়ে শুকানো হয়।
ধাপ ৫: রোদে শুকানো সুতা তাঁতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়।
ধাপ ৬: সাধারণ হাত-তাঁতে মূল শাড়ি রেখে তাতে রঙিন সুতা দিয়ে নকশা করা হয়।
ধাপ ৭: নকশা করার সময় আরো একবার ভাতের মাড় দেওয়া হয়।
ধাপ ৮: তারপর শাড়িতে নকশা তোলা শুরু হয়।
ধাপ ৯: রকমারি রঙের সুতা আর নকশায় শাড়ি সাজানো হয়।
জামদানি বয়নের এই অতুলনীয় পদ্ধতিকে একটি অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেইজ) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।
প্রাচীণকালের মিহি মসলিন কাপড়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে জামদানি শাড়ি বাঙ্গালী নারীদের অতি পরিচিত। মসলিনের উপর নকশা করে জামদানি কাপড় তৈরি করা হয়। জামদানি বলতে সাধারণত শাড়িকেই বোঝানো হতো। তবে জামদানি দিয়ে নকশী ওড়না, কুর্তা, পাগড়ি, রুমাল, পর্দা প্রভৃতিও তৈরি করা হতো। ১৭০০ শতাব্দীতে জামদানি দিয়ে নকশাওয়ালা শেরওয়ানির প্রচলন ছিলো। এছাড়া, মুঘল ও নেপালের আঞ্চলিক পোশাক রাঙ্গার জন্যও ব্যবহার হতো জামদানি কাপড়। কালের বিবর্তনে নতুন উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে জামদানি আবারও ফিরে এসেছে নতুন আঙ্গিকে।
সেতু ইসরাত,
উদ্যোক্তা বার্তা