সোনীয়া সুলতানা যখন নবম শ্রেণীতে পড়েন তখন তার ভাই তার বন্ধুদের সঙ্গে একটা বৈশাখী মেলায় স্টল নিয়েছিল। সোনীয়ার ভাই তাকে বলেছিল কোনো প্রোডাক্ট তৈরি করে দিলে তারা বিক্রি করে দেবে। সোনীয়া তার ভাইয়ের পুরাতন জিন্সের প্যান্ট কেটে এবং চটের বস্তা (যেটা চাউলের বস্তা) কেটে কিছু মোবাইল পার্স তৈরি করে দিয়েছিলেন ভাইকে। বিস্ময়কর শোনালেও সত্যি যে সবগুলো প্রোডাক্টই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল সে সময়। আর তখনই সোনীয়া খুবই উৎসাহ পেয়েছি যা থেকেই তার উদ্যোক্তা জীবনের শুরু।
উদ্যোক্তা সোনীয়ার বয়স যখন তিন বছর তখন তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। মা ছিলেন চাকরিজীবী। তিনি তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ভীষণ কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই সোনীয়া হাড়েহাড়ে টের পেয়েছিলেন একটা মেয়ের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া ঠিক কতটা জরুরী। খুব ছোট্ট বয়সেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি জীবনকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জীবনটা ঠিক ততটা সোজা না। সোনীয়ার জীবনে তার মা-ই ছিল অনুপ্রেরণার উৎস।
বর্তমানে সোনিয়া দেশীয় পোষাক, হস্তশিল্প, সুই-সুতা, ব্লক-বাটিক, পাট পণ্য, আচার, হ্যান্ড পেইন্টিং ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি প্রফেশনালভাবে কাজ শুরু করেছিলেন ২০০৯ সাল থেকে। তিনি যখন উদ্যোগ শুরু করেছিলেন তখন জীবনটা আজকের মত এতটা সহজ ছিলো না। এখনকার মতো ইউটিউব ঘেঁটে বা অন্য কোনোভাবে প্রোডাক্ট সোর্সিংয়ের ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না।
প্রথমদিকে প্রোডাক্ট সোর্সিং, দক্ষ কর্মীর অভাব, মফস্বল এলাকায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণের অসুবিধার মত সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়েছিলেন উদ্যোক্তা সোনীয়া। সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ-কিছুদিন বিভিন্ন জায়গায় পণ্য সোর্সিংয়ের জন্য প্রচুর ঘুরেছেন তিনি। অচেনা জায়গায় ছিনতাইর মতো ঘটনাও ঘটেছে বলে জানান উদ্যোক্তা সোনীয়া। পরে অবশ্য ভালো কাঁচামালের সন্ধানও পেয়েছিলেন তিনি। আর কর্মীদের নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষিত করে নিয়েছেন তিনি।
উদ্যোক্তা জীবনের শুরুতে মাত্র দশ হাজার টাকা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প আর কিছু নেই বলে মনে করেন সোনিয়া। তিনিই যেমন ঘর থেকেই প্রশিক্ষণ শুরু করেছেন। কারণ, ছোটবেলা থেকেই তিনি মাকে দেখেছেন, মা অফিসের কাজ শেষ করে বাসায় এসে সেলাইয়ের কাজ করতেন। তার কাছেই উদ্যোক্তা জীবনের হাতে খড়ি। তারপরে বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি এখনো প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন ।সেইফ এর একটি ড্রাইভিং কোর্সও কমপ্লিট করেছেন ডিসেম্বর মাসে।
বর্তমানে জাতীয় মহিলা সংস্থায় ফ্যাশন ডিজাইনিং এর উপরে একটি কোর্স করছেন তিনি। তার মতে একজন উদ্দ্যোক্তার সব ধরনের জ্ঞান থাকা জরুরি। যুব উন্নয়ন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক হতে, এছাড়াও বেসরকারিভাবে তিনি অনেক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলে জানান । বর্তমানে তার একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও আছে যেখানে ১৩ টা ট্রেডে বিভিন্নভাবে নারীদের প্রশিক্ষিত করে উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়।
উদ্যোক্তার অনন্য উদ্যোগ রঙিন সুতা নারী উন্নয়ন সংস্থায় বর্তমানে প্রায় ৮০ জন নারী কর্মী কাজ করছে।উদ্যোক্তা তার জীবনের সফলতার জন্য কঠিন পরিশ্রম করতে পিছপা হন না কখনো। তিনি বিশ্বাস করেন পরিশ্রমই সাফল্যের চাবিকাঠি। একজন মানুষের সফলতার সবটাই নির্ভর করে তার পরিশ্রম, আত্মত্যাগ আর সঠিক কর্ম পরিকল্পনার উপর। আর এর পাশাপাশি চাই পরিবারের সাপোর্ট। উদ্যোক্তা সোনিয়া তার উদ্যোগে সার্বক্ষণিক পাশে পেয়েছিলেন তার পরিবারকে। তারাই তাকে শক্তি আর সাহস জুগিয়েছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন সোনিয়া তার সফলতার পথে। উদ্যোক্তা এখন স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন সাজান নিজের হাতে। তিনি বিশ্বাস করেন, জীবনটা স্বপ্নের মতই সুন্দর। তিনি উদ্যোক্তা বার্তাকে কথা প্রসঙ্গে বলেন “এককথায় জীবন রঙিন, খুবই সুন্দর।”
উদ্যোক্তার এখন স্বপ্ন “রঙিন সুতা” কে ব্রান্ড হিসাবে তৈরি করা। প্রতিটি জেলায় একটা করে আউটলেট থাকবে এই স্বপ্ন দেখেন ভীষণ রকম। এছাড়াও সমাজে যেসব নারী স্বামী পরিত্যাক্তা, বিধবা অথবা অথবা খুবই দরিদ্র শ্রেণীর যাদের স্বাবলম্বী হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন তাদের পাশে থেকে কাজ করে যেতে চান তিনি। নতুন উদ্যোক্তা উন্নয়নে কাজ করতে চান। উদ্যোক্তা সোনিয়া বলেন, “তৃণমূল পর্যায়ে বাল্যবিবাহ, মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নারীর অর্থনৈতিক সক্ষমতা আনায়নে আমরা কাজ করছি, আরও বেশি কাজ করতে চাই।”
মার্জিয়া মৌ,
উদ্যোক্তা বার্তা