মেয়েটি সবসময় খুব হাসি-খুশি থাকতো। সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারতো। খুবই সরল ভাবে চিন্তা করতো। এতটাই সরল ছিলো যে, কেউ একটু হেসে কথা বললেই সেই মানুষটিকে আপন ভেবে ফেলতো। পরিবারিক গণ্ডীবদ্ধ জীবনে বেড়ে ওঠায় বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তার জ্ঞান ছিলো খুবই স্বল্প। তাই ‘সাহস’ ও ‘আত্মবিশ্বাস’ শব্দ দুটির প্রতি সুপরিচিত ছিলো না। সবাই বলতো মেয়েটির কোন গুনই নেই – বেগুন। ছোটবেলা থেকে কেউ কোন কাজে প্রসংশা বা উৎসাহিত করতো না। সব কাজে সে ছিলো অমনোযোগী ও খামখেয়ালি।
মেয়েটির নাম সাজিয়া সুলতানা মহুয়া। মধ্যবিত্ত পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। বাবা ছিলেন পাকিস্তান পিরিয়ডেরর এয়ারফোর্সের একজন অফিসার। মা গৃহিণী। যশোর সদরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করেন যশোর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও যশোর এমএম কলেজ-এ।
অর্থনীতিতে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় চাকরির জন্য সিভি তৈরি করতে গিয়ে দেখলেন, পড়াশোনার সার্টিফিকেট ছাড়া দক্ষতার ঝুড়ি খালি। চিন্তায় হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। সবসময় চিন্তা করতেন নিজের উদ্যোগে কিছু একটা করবেন। কিন্তু সেটা যে ব্যবসা হবে, কখনো ভাবেননি। তখন স্বপ্নগুলো ছিলো এলোমেলো। কখনো মনে হতো সংবাদ পাঠিকা হবেন তো কখনো মনে হতো ব্যাংকার হবেন। আসলে তার পাশে স্বপ্ন দেখানোর কোনো মানুষ ছিলো না। কারো সাথে যদি শেয়ার করতেন, সংবাদ পাঠিকা হবেন; সবাই হাসতো। চিন্তা করলেন সময় নেই, এবার নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে। সিদ্ধান্ত নিলেন কম্পিউটার ও ইংরেজি শিখবেন। এগুলো শেখার পর অনুভব করলেন শুধু শিখছেন কিন্তু দক্ষ হয়ে উঠেছেন না। ভাবলেন দক্ষ হতে হলে চর্চা করতে হবে। তখন সন্ধান পেলেন একটি সেচ্ছাসেবামূলক সংগঠনের। ততোদিনে বাবা মারা গেছেন। তাই মাথার উপর আলাদা একটা চাপ ছিলো।
সংগঠনের বেশ কিছু বিষয় ভালো লাগার ছিলো । সকলেই অধ্যায়নরত, পাশাপাশি বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করার মাধ্যমে নিজেদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালাতো। যেকোন কাজ ছেলে-মেয়েরা একত্র হয়ে অনায়াসে করে ফেলতো। সংগঠকদের আন্তরিকতা দেখে আমি ও তাদের কাজের ভিতর মিশে গেলাম। বড় বোনের বিয়ের দেড় বছর পর স্বামী মারা যায়। নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য বড় বোনও ছিলো হতাশাগ্রস্ত। তাই পরিবারে তাকে নিয়ে অনেক সমস্যা লেগেই থাকতো। এ পরিবেশ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য সংগঠনের কাজে সময় দিতেন।
উদ্যোক্তা বলেন, “সেই সময় অনেকে বলতো বাড়ির খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। সবাই ভাবতো মেয়েটি একদম গোল্লায় গেছে। কিন্তু আমার মনে হতো বনের মোষ তাড়ালেও আমার স্কিল তো ডেভেলপ হচ্ছে। পড়াশুনা পাশাপাশি আমি নিজের দক্ষতা উন্নয়নের কাজ করতে লাগলাম। জাতীয় যুব প্রশিক্ষন কেন্দ্র সাভার থেকে দর্জি, ব্লক-বাটিক কোর্স, যুব উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও বাজার ব্যবস্থাপনার উপর ট্রেনিং নিই; SME ফাউন্ডেশন থেকে কিভাবে নতুন ব্যবসা শুরু করা যায় সেই বিষয়ের ট্রেনিং নিই। তারপর কিছু দিন ব্লক বাটিকের ট্রেইনার হিসাবেও কাজ করি যবু উন্নয়নের অপ্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং। ততোদিনে আমি মাস্টার্স শেষের দিকে। পাশাপাশি সংগঠনে আসা বিদেশি যুব সংগঠকদের সাথে মেশার সুযোগ, ইয়োথ ক্যাম্পে হাইকিং-এর মতো গেমে অংশগ্রহণের সুযোগ; চাইল্ড ক্যাম্পের মনিটর হিসাবে সুযোগ পাই।”
এমন সময় সংগঠনের আভ্যন্তরিন সমস্যার কারনে সিদ্ধান্ত নিলেন সংগঠনে আর কাজ করবেন না। তারপর সামান্য কিছু অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০১৩ সালে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে মাত্র ১০০০০ টাকা ধার নিয়ে যশোরের ঐতিহ্যবাহী হাতের কাজের পন্য নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। যেহেতু সংগঠনে কাজ করতেন তাই পরিচিতটা ছিলো। যার কারণে শুরু থেকে বেশ সাড়া পেলেন। শুরুতে অনেকে অনেক কটু কথা বলেছে কিন্তু পরবর্তীতে তারাই তার কাজ ভালোবেসে গ্রহনও করেছে।
এমতাবস্থায় বড় বোনের ক্যানসার ধরা পড়লো। সাধারন চিকিৎসা দিতে পারলেও অর্থের অভাবে এই রোগের মূল চিকিৎসা দিতে ব্যার্থ হলেন। তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন উদ্যোক্তা মহুয়া। বিয়ের পর পরই মা হলেন। একটি ছেলে হলো কিন্তু জন্মের ৩ দিন পর মারা গেলো। এরপর অনেক যুদ্ধ মোকাবেলা করে তার কলিজার টুকরা মেয়ে জন্ম নিলো।
শত বাধা, কষ্ট পেরিয়ে পুনরায় নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে নেমে পড়লেন। যশোরের ঐতিহ্যবাহী হাতের কাজের ১০টা ড্রেস নিয়ে আবার শুরু করলেন। এখন তার কর্মী সংখ্যা ২৫ জন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘Mohua’s corner’ নামক পেজের মাধ্যমে সারাদেশে পন্য ডেলিভারি দিচ্ছেন। বর্তমানে মাসে আয় করছেন ৩০০০০ টাকা। ভবিষ্যতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সমাজের আর ১০টা মেয়ের কর্মসংস্থান তৈরি করতে চান উদ্যোক্তা মহুয়া।
তরুণদের উদ্দেশ্যে উদ্যোক্তা বলেন, “নিজেকে আগে দক্ষ করে তুলতে হবে তাহলে আর কাজের অভাব হবে না। যে উদ্যোগই গ্রহণ করুন না কেন মার্কেট যাচাই বাছাই করে তারপর কাজ শুরু করতে হবে। ঝুঁকি নেওয়া শিখতে হবে ও ঝুঁকি নিতে হবে। সততা ও পরিশ্রমই নিয়ে আসবে সাফল্য”।
সাইদ হাফিজ
উদ্যোক্তা বার্তা, খুলনা
এমন একজন সংগ্রামী নারীর প্রতি জানাই স্যালুট। সকল নারীর জন্য মডেল হিসাবে বেঁচে থাকুক সমাজের প্রতিটি অন্তরে। নিরন্তর শুভ কামনা করি।