ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিলো একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার। আমার বাবা, একজন সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসার পিছনে বাবার দিনরাত উৎসাহ এবং পরিশ্রম দেখে আমার ভিতরে একজন ব্যবসায়ী হওয়ার আগ্রহ তৈরী হয়।
পড়াশুনা শেষ করে সমাজের অন্যান্য আট দশটা ছেলের মতই আমিও চাকরির পিছনে ছুটি। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরিও করি। কিন্তু কোথাও একটা পিছুটান ছিলো, আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মনের ভিতরে ব্যবসায়ী হওয়ার সেই ইচ্ছেটা বারবার নাড়া দিত। মনে মনে ভাবতাম পরিশ্রম যেহেতু করছি, নিজের জন্য না কেনো? ব্যবসায়ী হওয়ার সেই অদম্য ইচ্ছে থেকেই আমি পথ পরিবর্তন করে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
কাজের শুরুটা আমার জন্য খুব সহজ ছিলো না, প্রতিবন্ধকতা ছিলো অনেকটাই। আর্থিক সঙ্কট, পরিবেশ পরিস্থিতি, কারো কাছ থেকে সহযোগীতা না পাওয়া, অনেকের বিরূপ মন্তব্য এবং নিজের সিদ্ধান্তহীনতা কাজের পথটাকে কঠিন করে তুলেছিলো। মানসিক মনোবল অনেকটা কমিয়ে দিতো, বাঁধা অনুভব করতাম চারদিক থেকেই। এইসব প্রতিবন্ধকতাগুলো আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিতো, ভাবতাম আমি হয়তো পারবো না। কিন্তু কিছু কঠিন পরিস্থিতি আমাকে এইসব প্রতিবন্ধকতা থেকে আলাদা করে ভাবতে শিখিয়েছে। সব কিছুর বিরুদ্ধে একা লড়াই শুরু করলাম। ভাবলাম সামনে এগুতে চাইলে শুরু করা প্রয়োজন, একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে শুরু করে ফেললাম। চেষ্টা করে যাচ্ছি সফল হবার।
কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনেক কিছুই মাথায় কাজ করতো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২ টা বিখ্যাত পণ্য নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটি হল আমাদের মতলবের ক্ষীর যেটাকে সবাই ক্ষীরসা বলে চিনে। আরেকটি চাঁদপুরের খাঁটি ইলিশ মাছ।
ক্ষীরসা ঐতিহ্য সম্পর্কে উদ্যোক্তা মুগ্ধ পোদ্দার বলেন, প্রাচীনকাল থেকে ক্ষীরসা কে কলাপাতায় মোড়ানো হতো বলে একে আঞ্চলিক ভাবে পাতাক্ষীরও বলে। প্রাচীনকাল থেকেই বংশ পরম্পরায় ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন বাংলার আদি ঘোষালরা। প্রচার নেই বলে অনেকে জানেও না, স্বাদ নেয়া তো দূরের কথা। যারা স্বাদ পেয়েছে তারা দূর দূরান্ত থেকেও সংগ্রহ করে। এমনি খেতেও মজা আর যদি পাটিসাপটা পিঠার ভেতর পুর হিসেবে দেয়া হয়, আমি বলছি এর স্বাদ আপনি কখনো ভুলবেন না।
ক্ষীরের জন্য বিখ্যাত মতলব। মুগ্ধ পোদ্দার-ক্ষীরসা বা পাতক্ষীরসা তৈরী সম্পর্কে বলেন সাধারনত, প্রতি কেজি ক্ষীরসা বা পাতক্ষীরসা তৈরিতে-৩ (তিন) কেজি দুধ প্রয়োজন হয়। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জাল দিতে হয় দুধ। দুধের সঙ্গে সামান্য (৫০ গ্রাম) চিনি ব্যবহার করা ছাড়া কিছুই ব্যবহার হয় না এখানে। তবে ডায়াবেটিক রোগীর জন্য বিশেষ অর্ডার থাকলে এ চিনিও দেয়া হয় না। জাল দিতে দিতে দুধ যখন ঘন হয় তখন মাটির পাতিলে রাখা হয়। ঘণ্টাখানেক পর ঠান্ডা হলে তা কলাপাতায় পেঁচিয়ে অথবা বর্তমানে মাটির হাড়িতে করে বিক্রিযোগ্য করা হয়। তবে হাতের যশ আর কৌশলেরও ব্যাপার আছে। ঘন করতে গেলে চুলোয় দুধে পোড়া লেগে যায়। তাই কাঠের বিশেষ লাঠি দিয়ে নাড়তে হয় সব সময়।
এছাড়া, আমার ব্যবসায়িক পদ্ধতির মূল নীতি হচ্ছে স্বচ্ছতা ও সততা। এই দুটো নীতির উপরেই ভর করে এগিয়ে যাচ্ছি। অনলাইনে ব্যবসা করতে গেলে অনেকেই পণ্যের মান এবং দাম নিয়ে লুকোচুরি করেন। আমি সেদিক দিয়ে আমার স্বচ্ছতা দেখাতে চাই। পণ্যের মান, বিবরণ এবং দামের বিষয় গুলো গোপন করতে চাই না।
Value edition এর কথা বলতে হলে বলবো, মতলবের এই ক্ষীরসা টা সেই আদি কাল থেকেই একটা প্রসিদ্ধ খাবার এবং এর গুণগত মান ঠিক আগের মতই আছে। এই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি প্রচার এবং প্রসারের অভাবে মতলবের মতো ছোট্ট একটা জায়গাতেই আবদ্ধ হয়ে আছে।
দোকানে বসে বিক্রি করার চিরাচরিত প্রথার পরিবর্তন এনে বর্তমান ব্যবসায়ীক নিয়মে যেমন e-commerce বা digital marking এর মাধ্যমে এই খাবারটিকে সবার কাছে তুলে ধরতে চাই। যেনো এই পরিচিতির মাধ্যমে আমি সহ মতলবের আরও কিছু পরিবারের কর্মসংস্থান এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার সুযোগ তৈরী হয়।
বাঙলীরা দুপুরে বা রাতে ভারী খাবারের পর অথবা যেকোনো পারিবারিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে দই/মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। দই মিষ্টির পাশাপাশি ক্ষীরসাকেও আপ্যায়নের মাধ্যম হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছি।
যদিও কাজের সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নেই, তবুও বন্ধু এবং শুভকাঙ্খিদের পরামর্শ আমাকে সমানে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। তবে কাস্টমারদের চাহিদার বিষয়গুলো সবচাইতে বেশি গুরুত্ব পায়।
আগেই বলেছি যে পণ্যটি নিয়ে আমি কাজ করতে চাইছি, এটা ঢাকা বা তার আশেপাশে পাওয়া যায় না। এই ক্ষীরসার গুণগত মান, এর স্বাদ দই মিষ্টি থেকে কিছুটা আলাদা। তারমধ্যে আমার ব্যবসায়ীক পদ্ধতি, কাস্টমারদের এবং তাদের চাহিদার প্রতি মূল্যায়ন, আমার সততা ও প্রতিশ্রুতি কাস্টমারকে আমার কাছ থেকে পন্য ক্রয় করার জন্য আগ্রহী করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
আমার ফ্যাক্টরি “বাঙালিয়ানা” মতলবে হলেও আমি ঢাকা থেকে অনলাইন সেল করি, আমার ক্ষীরশা ২ টা সাইজে পাওয়া যায় একটি রেগুলার সাইজ, অন্যটি প্রিমিয়াম সাইজ I
প্রত্যেকটা উদ্যোক্তার একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। যেহেতু এই পন্য নিয়ে মতলবের কেউ এখনও কাজ করেনি, তাই আমার ইচ্ছে এই জায়গায় নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার।
আমি নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচয় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।সারা দেশে ক্ষীরসার স্বাদ ছড়িয়ে দিতে চাই, সকলকে এর সাথে পরিচিত করতে চাই। চাই এর প্রচার এবং প্রসারের সাথে নিজের “বাঙালিয়ানা “নামটাও জড়িয়ে থাকুক।
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা