২০০৭ সালের দিকে বাড়িতে মা একটি ওভেন কিনলেন। বাসায় থাকার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই সেই ওভেনে নানান এক্সপেরিমেন্ট করা হতো। যাই বানান না কেন, খাবার খেয়ে সবাই প্রশংসা করত। একদিন এক বড় ভাই বললেন “পিচ্চি এইবার তোকেই পেস্ট্রি অর্ডার করবো।” অর্ডার নেবেন কেকের, তাও আবার টাকার বিনিময়ে? লোকে কেমন ভাববে, কী বলবে প্রশ্ন রয়ে গেল মনের ভেতর।
গল্পটা এটুকুই হতে পারতো। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা আজ নাও শোনানো হতো। ইডেন কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে সাদিয়া আফরোজ ভর্তি হলেন একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকে সম্পন্ন করলেন এমবিএ। চাকুরীর সূচনা হলো নিটল টাটা মোটর্স, বগুড়া জোনে।
বেচাকেনা মানেই যেন দোকান ঘর বাধ্যতামূলক এই ধারনাকে পাল্টে জেলাশহরে খুলে ফেললেন অনলাইন পেজ। ২০১৬ এর শেষের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। কোনো রকম পেজ বুস্ট আপের সুযোগ ছিল না। মুহুর্তেই অনলাইন ব্যবসাকে জেলাশহরে ছড়িয়ে দেওয়াও মুখের কথা নয়। অর্ডার আসতো না একদমই। টুকটাক করে শুরুতে ১২ মাসে ১২টা কেকও সেল হয়নি। কাছের একজন অর্ডার দিলেন ২০পাউন্ডের কেক। যা একা একা করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বাড়িতেও সবাই বেশ দুশ্চিন্তায় পড়লেন। কীভাবে একা হাতে ২০পাউন্ড ডেলভারী দেবে। ধাপে ধাপে ৪ভাগে ঐদিন ২০পাউন্ড কেক ডেলিভারি করা হলো। আজ দিন ফিরেছে, উদ্যোক্তা নিজে এখন প্রায় প্রতিদিনই এমন ২০/৩০ পাউন্ড কেক ডেলিভারি দিচ্ছেন। নওগাঁর প্রথম অনলাইন পেস্ট্রি শপটি গড়ে তুললেন এভাবেই। জেলাশহরে পেস্ট্রি শপ চলবেনা বলেছেন সবাই, কিন্তু কর্ম নৈপুণ্যের সৌভাগ্যে টিকে গেলেন। আজ অনেক বড় বড় কর্পোরেট অফিস, ব্যাংকেও নিয়মিত অর্ডার ডেলিভারি দিচ্ছেন নিজের গড়া পেস্ট্রিশপ থেকে।
ছোটবেলার নানান এক্সপেরিমেন্টই ছিল নিজের প্রশিক্ষণ। শুরুর দিকে কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। শতভাগ আত্মবিশ্বাস আর দক্ষতা ছিল পুঁজি। পরবর্তীতে নিজের দক্ষতাকে ঝালিয়ে নিত র্যাডিসনের একজন বিখ্যাত শেফের কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়া হয়েছিল। একটা সময় বগুড়ায় চাকুরী, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি রাজশাহীতে যাতায়াত আর নিজের ব্যবসা নওগাঁ এই তিনে দৌড়ঝাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন উদ্যোক্তা। এইক্লান্তিকে আনন্দ দিত পেস্ট্রিশপের কাজ।
চাকুরীর পাশাপাশি পেস্ট্রিশপের কাজ চালিয়ে গেলেও একটা সময় হিমশিম খেয়ে যেতে থাকেন উদ্যোক্তা। চাকুরী থেকে প্রয়োজনে ছুটি চাইলেও দায়িত্ব থেকে ছুটি মেলা সেখানে ভার। নিজের সুস্থতার চিন্তা ও পেস্ট্রি শপের বাসনাকে শীর্ষে রেখে চাকুরী থেকে ইস্তফা নিলেন। পুরোদমে সময়টা নিজের এবং নিজ উদ্যোগের।
জেলাশহরে ভালো কেক পাওয়া যেত না বলে ঢাকা থেকে কেক এনে সেলিব্রেশন করতো অনেকেই। কিন্তু একবার যারা সাদিয়া আফরোজের কেক খেয়েছেন তারা আর বাইরে যাননি। আর সন্তুষ্ট কাস্টমারের জন্যই রেফারেন্স কাস্টমার এখন বেশি।
কাজের জন্য এই পেশাজীবনে সমালোচনা এসেছে, আসছে আজও। তবে নেপথ্যে ছিল বাবার একটি কথা, “সেই ব্যক্তিই সমালোচিত, আর কর্ম আলোচিত।” এই বিশ্বাসে কাজ করে চলেছেন। সফলতা কতটা এসেছে তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখনো চলছে কি না। খাদ্যের মানোন্নয়নে পেস্ট্রি থেকে শুরু করে আরো অনেক খাবারের উপরে কাজ করতে চান উদ্যোক্তা সাদিয়া আফরোজ। পাশাপাশি আরো নতুন উদ্যোক্তা তৈরীতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে চালিয়ে যাবেন ট্রেইনিং সেশন।
সাদিয়া সূচনা