মিরপুর-৬ প্রশিকা মোড় দাঁড়াতেই উদ্যোক্তা রেশমা জাহান এসে নিয়ে গেলেন তার নতুন বুটিক হাউজ ‘স্বপ্ন কথা কুটির শিল্প’ ঘুরে দেখাতে। আগের শোরুমটি বাসার কাছে ছিল যেটা বন্ধ করে একটু দূরে-ই বড় পরিসরে নতুন ভাবে শুরু করলেন। শো-রুম ঘুরে দেখা গেল প্রায় ২০ ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করছেন। হাতের কাজ করা ওয়ান পিস, টু পিস, থ্রি পিস, শাড়ী, বেডকাভার, কুশন কাভারসহ বিভিন্ন কাভার, পাঞ্জাবী, পর্দা, বেবি ড্রেসসহ হ্যান্ডিক্রাফট এবং বিভিন্ন অর্ডারের পণ্য তৈরী করেন উদ্যোক্তা রেশমা জাহান।
কথায় কথায় জানা হল তার শুরুর দিকটা কেমন ছিল। মায়ের কাজ করা দেখে সেই ছোট বেলাতেই অনুপ্রেরণাটা পান। তখন থেকেই এসব কাজের ধারনা হয় তার। এইচএসসির পর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। স্বামী ব্যবসায়ী হলেও স্ত্রীকে সময় দিতেন। পড়াশোনাটা চালিয়ে গেলেন পাশাপাশি একটা স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন কিন্তু সন্তান, সংসার সামলে চাকরিটা আর কন্টিনিউ করতে পারেননি। সন্তানরা এখন অবশ্য অনেক বড় হয়েছে, মেয়ে ডাক্তার, ছোট ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে আর বড় ছেলে দেশের বাহিরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।
কিন্তু সে সময় চাকরি ছাড়ার পর বান্ধবীরা মিলে ভাবতেন কিছু একটা করবেন, অনেক ভেবে ৫ বান্ধবী মিলে পঁচিশ শত টাকা নিয়ে বুটিক এবং হ্যান্ডিক্রাফটের পণ্য নিয়ে কাজ শুরু করলেও ১ বছর না পেরুতেই অন্য বান্ধবীরা উদ্যোগ থেকে সরে যান। মনোবল হারাননি, এসএমই ফাউন্ডেশন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং প্রতিবেশী কুটির শিল্প থেকে প্রায় ১০-১২টি প্রশিক্ষণ নিয়ে দৃঢ় ভাবে এগিয়ে গেলেন রেশমা জাহান।
শুরুটা ২০০৯ সাল থেকে হলেও ২০১৪ তে ট্রেড লাইসেন্স করে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে শুরু করলেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ট্রেনিং করায় লোন সুবিধা পেয়েছিলেন। যথাসময়ে পরিশোধ করার জন্য আবারও লোন পেয়েছিলেন যেটাতে ব্যবসার পরিধি অনেক বেড়ে যায়। চালু করেন ট্রেনিং সেন্টার যেখান থেকে এপর্যন্ত প্রায় ৪ শত নারী পুরুষ ট্রেনিং পেয়েছেন। যাদের পণ্যই পরবর্তীতে উদ্যোক্তা রেশমা কিনে নেন।
ষড়ঋতুর দেশে সময়োপযোগী কালেকশন তৈরী করেন যেগুলো সারা দেশে পাইকারী দিয়ে থাকেন। কলকাতায় যাচ্ছে নিয়মিত তার পণ্য এছাড়াও আত্মীয়দের মাধ্যমে কানাডা, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে উদ্যোক্তা রেশমা জাহানের পণ্য যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার একটা কুটির শিল্প মেলায়ও গেছে রেশমার পণ্য।
শুরু দিকে কাছের এক বন্ধুর কারখানায় পণ্য তৈরী করলেও এখন নিজ কারখানাতেই তৈরী হচ্ছে সব পণ্য। এছাড়াও রাজশাহী, চুয়াডাঙ্গা, রাজবাড়ী এবং বগুড়ায় প্রায় ৩শত কর্মী আছে যারা নিয়মিত অর্ডারের কাজ করেন। স্থায়ী ভাবে আছেন ২০জন কর্মী। ব্যবসার জন্য কেউ কোন তথ্য নিতে চাইলে তিনি তাকে সময় দেন। এক্ষেত্রে রেশমা বলেন, ‘আসলে আমি কাজ করি নিজ উদ্যোগে, সম্মাননা পাওয়ার আশায় নয় বরং কাজ করলে সম্মাননা এমনিতেই ধরা দেয়’।
পুরস্কারের প্রত্যাশা না করলেও তার ঝুলিতে শেরে-বাংলা এ কে ফজলুল হক স্মৃতি পদকসহ প্রতিবেশী কুটির শিল্প থেকে ২০১৪-১৫ বিশেষ সম্মাননা, ২০১৮তে ব্রেইন লাইফ সম্মাননা এবং বিয়া’র মেন্টর হিসেবে সম্মাননা অর্জন করেছেন তিনি। তিনি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্সের একজন সদস্য। এছাড়াও সামাজিক দায়িত্ব থেকে পথশিশুদের নিয়ে স্কুল “পুষ্পকলি” স্কুলের সাথে কাজ করছেন। পথশিশুদের মায়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ‘অনিন্দিত নারী’ সংস্থার মাধ্যমে এবং ২০২০শে কাজ শুরু করেছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে। ময়মনসিংহে শুরু হয়েছে এই উদ্যোগ। তিনি হিউম্যান রাইটস লিগ্যাল এইড সোসাইটি ঢাকা জেলার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি মাদক এবং নির্যাতিতাদের নিয়েও কাজ শুরু করেছেন।
উদ্যোক্তা রেশমা জাহান বলেন, ‘ সমাজের জন্য কিছু দায়বদ্ধতা আছে যা সহজেই পালন করা যায় তাতে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি আসে। আমার খুব ইচ্ছে একটা বড় আবাসস্থল করবো যেখানে অসহায় অনেক বাবা-মা থাকবে নিজের মতো করে কিন্তু সেটাকে আমি বৃদ্ধাশ্রম বলতে চাইনা। সেটা হবে ‘তারার মেলা’। আর আমাদের সমাজে নিজের একটা আইডেনটিটি সবারই প্রয়োজন এবং আমাদের সবারই কিছু না কিছু প্রতিভা আছে। তা কাজে লাগাতে হবে কারো মুখাপেক্ষী নয়, নিজের সুযোগমতো কিছু একটা শুরু করুন সাথে মেধা, শ্রম এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যান সেটা একদিন বৃহৎ কিছুর রূপ নিবেই’।
বিপ্লব আহসান