চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে গেল বছরের অক্টোবরে মাস্টার্স শেষ করেন সানজিদা ওসমান। মাস্টার্সের ভাইবাতে স্যার জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘এখন প্ল্যান কি তোমার?’ সানজিদা অকপটে উত্তর দিয়েছিলেন: স্যার বিজনেস করব।
স্যারের চোখে মুখে একটা মুগ্ধতা ছিল, সেটা দেখে খুব কনফিডেন্স পেয়েছিলেন তিনি। ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন শিক্ষক সানজিদার কাজের কথা টুকটাক জানতেন, আরেকজন স্যার তখন বললেন “সে উদ্যোক্তা হবে, সে অলরেডি কাজ করছে।”
এরপর থেকেই সানজিদাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘বায়োস্কোপ’ নামের পেজ খুলে শুরু করলেন স্ক্র্যাপ বুক আর গৃহসজ্জার সামগ্রীর বিক্রি। যা তিনি নিজে হাতেই তৈরি করে থাকেন।
নিজ জেলা চট্টগ্রামে খুবই জনপ্রিয় সানজিদার পণ্য। চট্টগ্রাম বেইজ হলেও গত কয়েকমাস ধরে চট্টগ্রামের বাইরে পার্শ্ববর্তী জেলাতে পণ্য বিক্রি করছেন তিনি।
সম্প্রতি উদ্যোক্তা বার্তার মুখোমুখি হয়েছিলেন সানজিদা ওসমান। একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন উদ্যোক্তা হয়ে উঠার গল্প।
সানজিদা বলেন: মূলত গিফট আইটেম ও ঘর সাজানোর জিনিস এবং সবগুলোই নিজের হাতে বানানো। বিভিন্ন রকমের কাগজ, কার্ড বোর্ড দিয়ে এসব তৈরি করে থাকি।
বায়োস্কোপে কি কি পাওয়া যায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ফটো অ্যালবাম, বার্থডে অ্যালবাম, ওয়েডিং অ্যালবাম। পেপার ক্রাফট আমি রেডি করি যেগুলো বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠানে কাজে লাগে। এছাড়া কাগজ আর লাইটের মিশ্রণে বিভিন্ন বাসায় সাজ-সজ্জায় কাজে লাগে। মূলত আমি সৌখিন মানুষের জন্য কাজটা করি। কিন্তু সবার কথা চিন্তা করে আমি কাগজের আইটেমগুলো টেকসই করে করার চেষ্টা করি। যাতে সবাই পণ্যগুলো ক্রয় করতে পারে।’’
সানজিদা জানান, ‘‘আমি পেজ খুলি ২০১৫ তে, আর গ্রুপ ২০১৭ তে, আজ গ্রুপে মেম্বার প্রায় তিন হাজার। নিজের পড়া, স্টুডেন্টদের পড়ার চাপ মিলে কাজ করতাম খুব কম। তার ওপর স্ক্র্যাপ বুকের কাজ বেশি করতাম বলে মাসে ৩/৪ টার বেশি কাজ করাও হতো না। গ্রুপে মাসে ৩/৪ টা পোস্ট করতাম। মাস্টার্সের শেষ পরীক্ষা দিয়ে একদিন পর কিছু রেডিমেড প্রোডাক্ট কিনলাম যেগুলো আমার গ্রুপের কাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।ওগুলো সেল করা শুরু করলাম।’’
‘‘গত বছরের নভেম্বর, ডিসেম্বর নিয়মিত গ্রুপে ডেলিভারি আপডেট দিতাম আর কাস্টমাররা রিভিউ দিতে লাগল। গ্রুপ জমে উঠল। ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে ‘মেমসাহেব বসন্ত মেলা’র স্টল বুক করলাম। নতুন বছরের জানুয়ারি ১ তারিখ থেকে মেলার প্রস্তুতি শুরু। নিয়মিত কাজ করছি, মেলার জন্য করা কাজ গুলোই গ্রুপে আপলোড করতে লাগলাম, আর সেল হতে লাগলো। এভাবে মেলা শেষ করলাম ১৫ ফেব্রুয়ারি।’’
মেলা করে আমার বায়োস্কোপের মেলা জমে উঠে জানিয়ে তিনি বলেন: সম্প্রতি ৫০ তম অর্ডার রেকর্ড করেছি। আমার জন্য বড় প্রাপ্তি এটা।কারণ আমার কারখানা নাই, লোকবল নাই।
কোন পণ্যের বেশি অর্ডার আসে জানতে চাইলে বললেন: বেশি অর্ডার আসে গৃহসজ্জার পণ্যে, এছাড়াও স্ক্র্যাপ বুক, মেমরি বুকের ভালো অর্ডার পাই।
পণ্য পাবার পর ক্রেতাদের ভাষ্য কি? সানজিদা বলেন, ‘‘আলহামদুলিল্লাহ, বলা যায় আমার ক্রেতাদের একটা বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গা আমার প্রতি তৈরি হয়েছে। যার জন্য তাদের যেকোন প্রোগ্রামে আমার পণ্য তারা কিনেন।’’
শুরুর সময়কার কথা বলতে গিয়ে সানজিদা বললেন, গিফট আইটেমের পণ্য গুলি আমি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের জন্মদিনে দিতাম। পরে তাদের পরিচিত কারো জন্য তারা এসব আমাকে করে দিতে বলতেন। এভাবে অন্যের জন্য করতে করতে একসময় ভাবলাম বিষয়টাকে কেন ব্যবসাতে রূপ দেওয়া যাবে না?
একটা সময় চাকরি ইচ্ছা থাকলেও এখন ব্যবসায় পূর্ণ মনোযোগ দিতে চান এই উদ্যোক্তা। বললেন, ‘‘ব্যবসাতে আমি স্বাধীন, আমি আমার মতো করে সময় তৈরি করতে পারি, চিন্তা করতে পারি। চাকরিতে সেটা সম্ভব নয়। তাই ব্যবসাতেই মনোযোগ দিচ্ছি।’’
যারা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী তাদের উদ্দেশ্যে বন্দর নগরীর মেয়ে বললেন: যে কাজই করেন,নিয়মিত হতে হবে। কোথায় যেন পড়েছিলাম “তোমার পণ্যের জন্য কাস্টমার নয়,বরং তোমার কাস্টমারদের জন্য পণ্য খোঁজো।” আমি এখন আমার কাস্টমারদের বোঝার চেষ্টা করি,তারা কেমন পণ্য চায়, আমার উদ্যোগ “বায়োস্কোপ”কে ওভাবেই সাজাচ্ছি।
বর্তমানে নিজেকে গর্বের সঙ্গে উদ্যোক্তা পরিচয় দিতে পারি জানিয়ে সানজিদা বলেন: ‘‘এতোদিন নিজেকে একজন উদ্যোক্তা বলতে সাহস পেতাম না, বলতাম আমি একজন ক্রাফটার। এখন গর্ব করে বলি আমি একজন উদ্যোক্তা।’’
ডেস্ক রিপোর্ট, উদ্যোক্তা বার্তা