রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার পুরানতাহিরপুর গ্রাম। যেখানে বাংলা ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান আমলে সেফাতুল্লাহ শেখ ওরফে সুন্দর শেখ নামে এক ব্যক্তি ২৫ থেকে ৩০ টি আমগাছ লাগানোর মধ্য দিয়ে বাগান তৈরি করেছিলেন। লোকমুখে শোনা যায়- সুন্দর শেখ ব্যবসার কাজে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতেন। একটা সময় তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় যান। সেখানে অনেক আমবাগান দেখেন এবং তখন তিনি ফিরে এসে সিদ্ধান্ত নেন নিজ এলাকায় একটি আমবাগান গড়বেন। এভাবেই তৈরি হয়েছিলো ‘সুন্দরশেখের আমবাগান’।
বর্তমানে ১৬ বিঘা জমির ওপর আমবাগান রয়েছে। ৩০টি আমগাছের সঙ্গে কালক্রমে আরো অনেক আমগাছ যুক্ত হয়ে এখন ১৫০টি আম গাছ রয়েছে বাগানে। এখানে রয়েছে বাহারি জাতের আম। প্রচলিত জাতের বাইরেও রয়েছে কাঁচামিঠা, কালিয়া, কুয়াপাহাড়ি, কালাপাহাড়, খিরসাপাত, দিলসাদ, বোম্বাই, মোহনভোগ, ক্ষুদি খিরসাপাত সহ অসংখ্য জাতের আম।
সুন্দর শেখ মারা যাবার পূর্বেই তার ৭ কন্যা মরিজান বেগম, জরিনা বেগম, ছকিনা বেগম, চামেলি বেগম, নাজমা বেগম, আকলিমা বেগম এবং পিঞ্জির বেগমকে বাগানের দায়িত্ব দিয়ে যান। পরবর্তীতে সুন্দরশেখের জামাতাগণ বাগানটি দেখাশোনা করতেন। বর্তমানে সুন্দরশেখের কয়েকজন কন্যা ও জামাতা বেঁচে না থাকায় বড় কন্যা মরিজান বেগমের পুত্র আলহাজ্ব ইসাহাক আলী, মোঃ রফিকুল ইসলাম এবং ছোটপুত্র মোঃ ইব্রাহিম আযম এবং অন্যান্য কন্যাদ্বয়ের জামাতা এবং সন্তানরা বাগানটি দেখাশোনা করছেন।
অনেক বছরের পুরাতন হওয়ায় বাগানটিকে ঘিরে শুধু পুরানতাহিরপুরবাসী নয়, আশপাশের এলাকার মানুষের কাছেও বেশ স্মৃতিময় বাগানটি। গ্রামের বেশিরভাগ লোকজনই বাগানটি গড়ে ওঠার অনেক পরে জন্মেছে। হাতে গোনা কয়েকজনকে পাওয়া যাবে যারা বাগানটি তৈরি নিজ চোখে দেখেছে। তার মধ্যে একজন মোঃ দবির উদ্দিন। উদ্যোক্তা বার্তাকে তিনি জানান, এই বাগান তৈরির উদ্যোগটি গ্রহণ করেছিলেন সুন্দর শেখ। বাগানটি আমার চোখের সামনে তৈরি হয়েছে এবং বাগান তৈরির সময় আমি মাটি কাটার কাজ করেছি এখানে। বাগানটি আমাদের পুরানতাহিরপুরবাসীর কাছে খুব স্মৃতিময় এবং গর্বের, বলতে বলতে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।
রাজশাহী অঞ্চলের আম বিখ্যাত। আর আমের নগরী রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় এত পুরাতন আমবাগান যেখানে অসংখ্য জাতের গাছ রয়েছে তা পুরানতাহিরপুরবাসী এবং রাজশাহীবাসীর জন্য গর্বের। গ্রামের আট থেকে আশি সকলের স্মৃতিমাখা বাগান সুন্দর শেখের আমবাগান। স্থানীয়দের কাছে এই বাগানটি ‘সুইন্দেশেকের’ বাগান নামেই বেশি পরিচিত। স্কুলে যাবার পথে বেশি রোদ থাকলে বাগানের ভেতর ছায়াশিতল জায়গা দিয়ে যাতায়াত, স্কুল থেকে ফেরার পথে ঝড়ের মধ্যে বাগানে আম কুড়িয়ে বইখাতা ভিজিয়ে বাসায় ফেরা পুরানতাহিরপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে যেন এক উৎসব। তরুণদের বিকেলে ক্রিকেট খেলা আর মাঝ বয়সী বা বৃদ্ধদের আমবাগান ঘেসে আক্কাসবাজার চায়ের আড্ডায় মাতা এগুলো যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। পথযাত্রীদের বাগানে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়া এগুলো যেন সময়ের সঙ্গে সুন্দরশেখের আমবাগান ঘিরে তৈরি হওয়া পুরানতাহিরপুরের ঐতিহ্য।
বর্তমানে দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য দর্শনার্থী ৭৮ বছরের পুরানো সুন্দর শেখের বাগানটি দেখতে যান। এছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে বাগানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে সফরেও যায় অনেক প্রতিষ্ঠান। সবকিছু মিলিয়ে ঐতিহ্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে সুন্দর শেখের আমবাগান।
তামান্না ইমাম
রাজশাহী ডেস্ক, উদ্যোক্তা বার্তা