রজনী বেক্টর। জন্ম পাকিস্তানের করাচিতে। দেশ ভাগের পর পরিবারের সাথে চলে আসেন দিল্লীতে। রজনীর বয়স তখন মাত্র ১৭। বিয়ে হয়ে গেল লুধিয়ানার একটি ব্যবসায়িক পরিবারে। বিয়ের পর রজনী তাঁর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন।
রজনী রান্না-বান্না ভীষণ ভালোবাসতেন। রান্নার প্রতি তার এতোটাই ঝোঁক ছিলো যে, বাড়িতে কেউ এলেই তাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন তিনি। সবার প্রশংসায় দিন দিন তার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যেতে থাকলো। বিয়ের পর রজনীর ৩ পুত্র সন্তান জন্ম নিলো। তাদের লালন-পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রজনী। কালের পরিক্রমায় ছেলেরা বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনার জন্য পাড়ি জমালে রজনী হয়ে পড়েন একদম একা।
রান্না-বান্নার প্রতি প্রবল আগ্রহ থেকেই বেকিং শিখতে পাঞ্জাব এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। রজনীর আইস ক্রিম, পুডিং, কেক, সালাদ এবং কুকিজের সুনাম খুব জলদি শহরে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। রজনী বিভিন্ন স্বাদের আইসক্রিম বানাতে শুরু করলেন এবং লোকাল বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে স্টল নিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করতে থাকলেন। তাঁর স্টলে ভীড় এতই লেগে থাকতো যে একবার “কোয়ালিটি” আইসক্রিম এর ম্যানেজার স্বয়ং তাঁর স্টলে আইসক্রিম খেতে আসেন।
রজনী খুব ভালো রেসপন্স পেতে থাকলেন। লোকজন তাকে অনুরোধ করতে শুরু করলো ক্যাটারিং চালু করার জন্য। বাসার রান্নাঘর, একটি ওভেন আর ৩০০ টাকা- এই ছিল মূলধন। রজনীর রান্নার খবর ছড়াতে থাকলো। পার্টি আর অনুষ্ঠানের খাবারের অর্ডার আসতে থাকলো হুহু করে। অর্ডার এর চাপ এতই থাকতো যে রজনীকে মাঝেমধ্যে অর্ডার নিতে হিমশিম খেতে হত এবং না করতে হত। কিন্তু ক্লায়েন্টরা না শুনতে নারাজ। তারা বলতেন, “আমরা কিছু জানিনা, আমাদের অর্ডার নিতেই হবে।“
১৯৭৮ সাল। ২০,০০০ টাকা পুঁজি নিয়ে রজনী তাঁর বাড়ির পেছনের উঠানে একটা ছোট আইসক্রিম ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট স্থাপন করলেন। কর্মী নিয়োগ দিলেও, রজনী নিজে সব কাজ করতে পছন্দ করতেন। স্বামী ধর্মবীর বেক্টর রজনী’কে ব্যবসার নাম রাখার পরামর্শ দিলেন। জন্ম হল একটি ব্র্যান্ডের, “মিসেস বেক্টর’স ক্রেমিকা ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড”। ক্রিমের নানান আইটেম তৈরি করতেন বলে ব্র্যান্ডের নাম দিলেন ক্রেমিকা। ক্রেমিকা শব্দটি এসেছে হিন্দিতে “ক্রিম কা” অর্থাৎ “ক্রিম থেকে”। স্বামী এবং ৩ ছেলে বিজনেসে যোগ দিল। তাদের সহায়তায় রজনী’র ব্যবসার মূল্যমান বিস্ময়করভাবে দাঁড়ালো ২০ কোটি টাকায়।
এবার একটা বড় সুযোগ আসে। ১৯৯৫ সালে ম্যাকডোনাল্ডস ইন্ডিয়াতে প্রবেশ করে লোকাল সাপ্লায়ার খোজ করতে থাকে। বার্গার বান এর জন্য (বার্গার এর রুটি) ম্যাকডোনাল্ড ক্রেমিকা কে সিলেক্ট করে। ক্রেমিকা’র কারখানায় তৈরী হতে থাকে ক্যাডবেরি এবং আইটিসি সানফিস্ট এর বিস্কিট। তাদের নিজস্ব নামের ব্র্যান্ড “মিসেস বেক্টর’স ক্রেমিকা” নামেও তারা ব্রেড, বিস্কিট এবং সস বিক্রি করতে থাকেন।
২০০৬ ক্রেমিকার মূল্যমান দাঁড়ায় ১০০ কোটি টাকায় যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৩০%। বিখ্যাত ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি গোল্ডম্যান স্যাক ৫০ কোটি টাকায় ১০% শেয়ার কিনে নেয়। ২০১১-১২ সালে ক্রেমিকা বার্ষিক ৬৫০ কোটি টাকার সেলস ক্রস করে।
বর্তমানে রজনীর ফুড ফ্যাক্টরি সবচেয়ে বড় খাদ্য সরবরাহকারী কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন লোকেশনে ৪০০০ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। রজনী বেক্টরের কোম্পানি ‘Cremica’ এই মুহুর্তে সমগ্র উত্তর ভারতের সবচেয়ে বড় বিস্কিট ব্র্যান্ড।৬০টির বেশি দেশে তাঁর আইসক্রিম, ব্রেড এবং বিস্কিট রপ্তানি হয়। ক্রেমিকা ফুডের বারবান, ক্র্যাকার্স, এবং ক্রিম ফিল্ড বিস্কিট ভারতের ২৩টি প্রদেশের ৫,৫০,০০০ আউটলেটে বিক্রি হচ্ছে।
রজনী বেক্টরের আরেকটি ব্র্যান্ড English Oven ভারতের সর্ববৃহৎ প্রিমিয়াম বেকারি ব্র্যান্ড। এছাড়াও ক্রেমিকা পরিচালনা করছে ভারতের সর্ববৃহৎ টমেটো কেচাপ লাইন যা বছরে ২.৫ মিলিয়ন স্যাশে প্যাকিং করতে সক্ষম। ভারতে পরিচালিত আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড যেমন- Pizza Hut, Burger King, Papa John’s এ ব্রেড, বার্গার বান, সস, পিজ্জার বেজসহ আরও নানান কনফেকশনারি আইটেম সরবরাহ করে ক্রেমিকা ফুড। ভারতের Canteen Stores Department (CSD) এবং ভারতীয় রেলওয়ের ও খাদ্য সরবরাহ করে ক্রেমিকা।
৮৩ বছর বয়সী রজনী। এমন অনেক দিন পার করেছেন যখন ৩-৪ ঘন্টা মাত্র ঘুমিয়েছেন। সংসার, ঘর-বাড়ি, পরিবার, ব্যবসা সব সমানতালে সামলিয়েছেন। ফলাফল ছিল অসাধারণ। মিলেছে স্বীকৃতিও। সরকার এবং নানান সংস্থা থেকে রজনী পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার, সংবর্ধনা, এওয়ার্ড। ২০০৫ সালে ভারতের প্রেসিডেন্ট আব্দুল কালাম এর কাছ থেকে পেয়েছেন এওয়ার্ড। আব্দুল কালাম তাকে দেখেই বলেছিলেন, ওহ! আপনিই সেই আইস ক্রিম লেডি?
২০২১ সালে এই আইস ক্রিম লেডি রজনী বেক্টর প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ এর হাত থেকে অর্জন করেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মশ্রী এওয়ার্ড।
ডেস্ক রিপোর্ট
উদ্যোক্তা বার্তা