রতন মাহমুদ ২০১৪ সালে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র কাছ থেকে ২০০০ টাকা ধার নিয়ে পৈতৃক নিবাস শেরপুরে শুরু করেন তার উদ্যোগ একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। তার এই যাত্রায় পাশে পাননি তার পরিবারের কাউকেই। তিনি নিজেই ছিলেন নিজের অনুপ্রেরণা। বর্তমানে তিনি কাজ করছেন ব্লক-বাটিক, ফ্রি হ্যান্ড কুশিকাটা, হস্তশিল্প ও তৈরি পোশাক সামগ্রী নিয়ে।তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের নাম “ড্রেস হাউজ এন্ড হস্ত শিল্প কুটির”। বর্তমানে তাঁর ব্যবসায়ের মূলধনের পরিমাণ প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা।
ব্যবসা শুরু করার আগে জনাব রতন মাহমুদ পরিবারসহ ঢাকায় বসবাস করতেন। তিনি ২০১০ সালে মিরপুর-১০ থেকে আর্ট ডিজাইনের উপর একটি কোর্স কমপ্লিট করেছিলেন। এবং আজিজ সুপার মার্কেট শাহবাগ ঢাকা, বাংলার রঙ এ ডিজাইনার হিসেবে চাকরি করতেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণের কারণে কাজের দক্ষতা খুব ভাল ছিল। সবকিছু মিলিয়ে ভালোই চলছিল। কাজ ভাল ছিল ভাল অঙ্কের সেলারিও ছিল। পরিবার নিয়ে ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল জনাব রতনের। কিন্তু দুই বছর পরে ঘটে বিপত্তি। ম্যানেজার ঠিকমত প্রতি সম্মাননী ক্লিয়ার না করায় রাগ করে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এবং এক পর্যায়ে রাগ করে তিনি ঢাকাতে পরিবার রেখে পৈতৃক নিবাস শেরপুর এর ইশিবপুর গ্রামের বাড়িতে চলে যান। গ্রামে আসার পর তার সময় যেন কিছুতেই কাটছিল না। চিন্তা করলেন কিছু একটা করবেন। কিন্তু তিনি যখন গ্রামে আসছিলেন তখন তার কাছে কোন পুঁজি ছিল না, যা দিয়ে তিনি ইচ্ছা করলেই কোনো কিছু উদ্যোগ শুরু করতে পারছিলেন না।
যে কোনো উদ্যোগ শুরু করার আগে মূলধন অনেক বড় একটি ব্যাপার। মূলধন ছাড়া কোনো উদ্যোগ শুরু করাই সম্ভব ছিলনা তার পক্ষে। পরিবারও পাশে ছিল না। গ্রামে একাই ছিলেন তিনি। দীর্ঘ দুই মাস এভাবেই ঘোরাফেরা করেন তিনি। এভাবে ঘোরাফেরা করতে দেখে অনেকেই বললেন আশেপাশে কোন দোকানে চাকরি নিতে। কিন্তু রতন ভাবলেন কোন দোকানে চাকরি নিলে তারা দুই থেকে পাচ হাজার টাকা স্যালারি দিবে, কিন্তু তিনি যখন ঢাকায় রংয়ের কাজ করতেন তখন প্রতি মাসে স্যালারি পেতেন ৩০ হাজার টাকা।এসব কিছু চিন্তা করেই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি কোনো চাকরি করবেন না।
নিজে আর্ট ডিজাইনের কাজ জানার কারণে আত্মবিশ্বাস ছিল নিজের উপর। সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই কিছু একটা করবেন । যেই চিন্তা সেই কাজ। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ২০০০ টাকা ধার করলেন তিনি। একটি ছোট্ট কাঠের ফ্রেম তৈরি করে নিলেন এবং কাপড় কিনে ডিজাইন করলেন নিজেই। ডিজাইন করা শেষে স্যাম্পল গুলো তিনি ঢাকা পাঠিয়ে দিলেন। জব করার কারণে অনেক ক্লায়েন্টের সাথে আগে থেকেই সখ্যতা ছিল জনাব রতনের। ডিজাইনগুলো দেখে তারা খুব বেশি পছন্দ করে ফেলে এবং তারা প্রথমেই ১৫ হাজার টাকার একটি অর্ডার করেন। রতন দেখলেন তার কাছে তো ১৫ হাজার টাকা নেই। কিভাবে কাজ কমপ্লিট করবেন এই চিন্তা করতে থাকলেন। কোন সুবিধা করতে না পেরে তিনি ক্লায়েন্টদের জানান তার কাছে কোন টাকা নেই। তারা যদি অগ্রিম কোন টাকা দেয় তাহলে রতন তাদের অর্ডার গুলো কমপ্লিট করে দিতে পারবেন। ক্লাইন্ট ৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয় রতনের কাছে। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে রাত দিন পরিশ্রম করে কাজ কমপ্লিট করে ফেলেন রতন এবং তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। কাপড়ের মান, কাজ সব ভালো থাকার কারণে তারাও খুব সহজেই প্রোডাক্ট গুলো বিক্রি করে দেয়। এবং এর পরেই তারা আরও ৩৫ হাজার টাকায় একটি অর্ডার করে। সে অর্ডারেরও সময় ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। নিজ হাতে সমস্ত কাজ তিনি করতেন। প্রোডাক্টের কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে সমস্ত কিছু। পরিশ্রম করতে কখনোই পিছপা হননি এই তরুণ উদ্যোক্তা। বিশ্বাস ছিল নিজের উপর তিনি পারবেন। রাতদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তিনি। এভাবে চলতে চলতে ছয় মাস পর উদ্যোক্তার মূলধন দাঁড়ায় দেড় থেকে দুই লক্ষ টাকার কাছাকাছি।
তিনি যখন কাজ শুরু করেছিলেন মূলধন অল্প টাকায় গ্রামের এক পড়ে থাকা গরুর ফার্ম ভাড়া নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। মালিকের গরুতে লস হয় এবং গরু না থাকায় ফার্মটি পড়েছিল। ভালো দোকান ভাড়া নেওয়ার মত টাকা ছিলনা রতনের কাছে। অল্প টাকার মধ্যে ফার্মটি ভাড়া নিয়েছিলেন এবং কাজ করার একটি পরিবেশ তৈরি করেছিলেন তিনি।ছয় মাস পর যখন টাকা হল তখন রতন ভাবলেন তার পরিবেশটা চেঞ্জ করা দরকার। এরপর মহল্লাতে একটি দোকান ভাড়া নিলেন এবং রং করে একটি সুন্দর পরিবেশ তৈরী করলেন। উদ্যোক্তার কাছে কন্টিনিউয়াস কাজের অর্ডার আসতে থাকে। ৭ থেকে ১৫ দিন পর পর তিনি প্রোডাক্ট ডেলিভারি করেন। কাজের ম্যাটারিয়াল থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ নিজে করেন তিনি। দোকান ভাড়া নেওয়ার পর তিনি কিছু ডামী কিনেন এবং প্রডাক্টগুলো ডিসপ্লে করে রাখেন। রাস্তা দিয়ে লোকজন যাওয়ার সময় ড্রেসগুলো দেখে আকৃষ্ট হতে এবং কাস্টমারের ভিড় জমে যেত। এর মধ্যে চলে আসে ঈদ। ঢাকায় ক্লায়েন্টের ভিড় এবং দোকানে কাস্টমারের ভিড়। এক মুহূর্ত যেন বসে থাকার অবকাশ নেই রতনের। তৈরি হওয়ার সাথে সাথেই সবগুলো প্রোডাক্ট বিক্রি হতে থাকে। দৈনিক যদি দশ পিস তৈরি করেন তিনি বাকি চাহিদা থাকে পনেরো পিসের।রক্তের অতিরিক্ত চাহিদা থাকায় উদ্যোক্তা অন্য উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করলেন। এক ঈদের আগেই প্রোডাক্ট বিক্রি হয় প্রায় ৮ লক্ষ টাকার।
এরপর আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রতনের। মেইন বাজারেই একটি বড় দোকান ভাড়া নেন তিনি। বর্তমানে উদ্যোক্তার মূলধনের পরিমাণ প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকার কাছাকাছি।এছাড়াও তিনি একটি কারখানা স্থাপন করেছেন। উদ্যোক্তার বর্তমানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৩২ জন।এতকিছু অর্জনের পরও রাত দিন পরিশ্রম করেন রতন। কর্মীদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন তিনি। তিনি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন প্রত্যেকটা জেলায় শোরুম নেবার। দেশের তরুণ প্রজন্মকে তিনি উদ্যোক্তা হবার জন্য এগিয়ে আসতে বলেন। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং দিকনির্দেশনা থাকলে একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া যায় বলে বিশ্বাস করেন তিনি। নিজের আত্মবিশ্বাস আর কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন তার নিজস্ব ব্যবসা।
মার্জিয়া মৌ, উদ্যোক্তা বার্তা