হ্যান্ডমেড ও আর্টিস্টিকে রিফ্লেকশনস

0
উদ্যোক্তা - সাবরীনা ইসলাম

কাঁচের ওপর খোঁদাই, নক্সা ও রং করার এ ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এর আগে কখনো ছিলোনা। উদ্যোক্তা সাবরীনা ইসলাম প্রথমবারের মতো ‘রিফ্লেকশনস’ নামে এ ব্যবসা শুরু করেন।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন এবং পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির আই.বি.এ থেকে এম.বি.এ করেন। উদ্যোক্তা আইনের দিকে না গিয়ে ব্যবসার দিকেই মনোনিবেশ করেন।

উদ্যোক্তা ছাত্রী অবস্থায় যখন আমেরিকায় পড়াশোনার জন্য যান তখন স্টেইনড গ্লাস এর প্রতি প্রথম এক্সপোজার হন। উদ্যোক্তা সাবরিনা পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে আমেরিকার বিভিন্ন চার্চ ,মিউজিয়াম সহ বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। চার্চে যেয়ে উদ্যোক্তা প্রথম স্টেইনড গ্লাস দেখে অভিভূত হয়ে যান।

ছাত্রী অবস্থায় আমেরিকা থাকাকালীন উদ্যোক্তা স্টেইনড গ্লাস এর উপর একটি ছোট কোর্স কমপ্লিট করেন। কোর্সটি কমপ্লিট করার পরে উদ্যোক্তা সেই সময় এই বিষয়টি নিয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি।

আমেরিকায় শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে উদ্যোক্তা ১৯৯৪ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৯৬ সালে উদ্যোক্তার পরিবার ঢাকায় তাদের বাড়ি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন উদ্যোক্তা সাবরিনার বাড়ির দরজা জানালার ডিসাইন কেমন হবে তার একটা কল্পনার রেখা চিত্র পরিবারের মাঝে শেয়ার করেন। কেননা উদ্যোক্তার বাড়িটি ছিল লেকের পারে। শোবার ঘর থেকে লেকের সৌন্দর্য দেখতে কেমন হবে, লেকের পুরো ভিউ টা ভালো ভাবে অবলোকন করা যাবে যদি ঘরের দরজা জানালাগুলো যদি স্টেইনড গ্লাস দিয়ে সাজানো যায়।

পরিবারের সম্মতিতে ঢাকায় তখন খোঁজা হয় স্টেইনড গ্লাস। কিন্তু দেশের কোথাও স্টেইনড গ্লাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। পরে উদ্যোক্তা দেশের বাইরে থেকে তাদের নিজ বাড়ির জন্য স্টেইনড গ্লাস ইম্পোর্ট করে আনেন। সেই সময় উদ্যোক্তা ভাবলেন যে এটাকে ইচ্ছা করলে ব্যবসায় রূপান্তর করা যায় এবং এই কাজটি আমরা নিজেরাই করতে পারি।

মনের ভাবনা ও কল্পনাকে বাস্তবে রূপদানের লক্ষ্যে উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগে ইন্ডিয়া ,থাইল্যান্ড ও আমেরিকায় গিয়ে স্টেইনড গ্লাস দোকানের নারী কর্মচারীদেরকে এই বিষয়টি শিখাতে শুরু করেন। এভাবেই আস্তে আস্তে পরবর্তীতে কাঠের উপর নকশা ,রং করার কাজ করতে কররে ব্যবসা শুরু হয়ে যায়, যার নাম ‘রিফ্লেকশনস’। বর্তমানে বাংলাদেশে একমাত্র কোম্পানি ‘রিফ্লেকশনস’ যা কিনা সমস্ত সেক্টরে স্টেইনড গ্লাস এর ব্যবহার নিয়ে কাজ করে। শুরুতে মাত্র দু’জন কর্মী নিয়ে উদ্যোক্তা কাজ শুরু করেন। বর্তমানে একটি বেশ বড় আকারের শোরুম ও একটি কারখানা আছে যেখানে ২০ জন কর্মী কাজ করছে। উদ্যোক্তা এখন বেশ বড় পরিসরে কাজ করছেন। এভাবেই উদ্যোক্তা সাবরিনা ইসলাম সামান্য শখ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উদ্যোক্তা জীবনে প্রবেশ করেন।

জানালা কিংবা দরজার নানা মাত্রিক স্টেইনড গ্লাস ডিসাইন গৃহকে দেয় বৈচিত্রময় শোভা। অপরূপ স্টেইনড গ্লাস ডিসাইন ঘরের আলোর মাঝে খেলা করে দেয় নান্দনিক শোভা। ডেকোরেটিভ গ্লাস যে কোনো জায়গায় ব্যবহার করা যায়। রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্ট ,কমার্শিয়াল প্রজেক্ট যেমন হোটেল ,রেস্তোরাঁ ,মসজিদ, চার্চে প্রচুর ব্যবহার হচ্ছে বর্তমানে এই স্টেইনড গ্লাস।

স্টেইনড গ্লাস এর ধারণাটি শুরু হয়েছিল উন্নত বিশ্বে চার্চ থেকে। কেননা তখন লোকজন পড়াশোনা জানতোনা। তাই বাইবেলের স্টোরি গুলো তখন স্টেইনড গ্লাস এর মাধ্যমে একে একে বোঝানো হতো। বর্তমান বিশ্বে গত ২০/৩০ বছরে স্টেইনড গ্লাস এর গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

শাওয়ারের ক্লোসেট, বাথরুম, কিচেন কেবিনেট, সাইড লাইট ,স্কাই লাইট ,সিলিং প্যানেল, সিঁড়ির রেলিং, টেবিল টপ ফার্নিসার, ফ্লাওয়ার ভাস ইত্যাদি নানান কাজে স্টেইনড গ্লাস এর প্রতি ভোক্তাদের চাহিদা রয়েছে। স্টেইনড গ্লাস এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল বলে উদ্যোক্তা জানান। বর্তমানে আর্কিটেকচার ফার্ম, ইন্টেরিয়র ডিসাইনসহ ছোট বড় প্রতিষ্ঠান এখন স্টেইনড গ্লাস এর প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

স্টেইনড গ্লাস দেখতে যতটা আকর্ষণীয়, এর তৈরী প্রক্রিয়াটা বেশ কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। প্রথমে নকশাটি একে নিতে হয় কাগজে। তারপর নকশাটি কাছের উপর ফেলে ফ্লায়ারস দিয়ে কাঁচ কাটা হয়। গ্রাইন্ডার দিয়ে মসৃন করা হয় কাঁচকে। কাছের টুকরোগুলোকে কোপের ফয়েল দিয়ে মুড়ে পাশাপাশি একটি ফ্রেমে রাখা হয়। এরপর চলে সল্টারিং আয়রনের মাধ্যমে লেপ দিয়ে কাঁচের টুকরোগুলোকে জোড়া দেয়ার প্রক্রিয়া। সবশেষে এদের বন্ধন দেয়া হয়। এভাবেই তৈরী হয় কাঁচ কেটে কেটে স্টেইনড গ্লাস এর অনবদ্য রূপ।

একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে সাবরিনা ইসলাম দেশের যে সব নারীরা উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন তাদের সম্পর্কে বলেন,”নারীরা যেন নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখেন এবং কখনও স্বপ্ন দেখা বন্ধ না করেন।”

উদ্যোক্তা তার রিফ্লেকশনস প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বলেন, “এখনো স্টেইনড গ্লাস একটি আর্ট ফর্মে আছে। প্রতিটা স্টেইনড গ্লাসএ এখনো হ্যান্ডমেড ও আর্টিস্টিক বিষয় আছে প্রোডাক্টে। এখন ব্যবসাটি প্রফেশনাল এর পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ নিয়ে চলছে বলে জানান উদ্যোক্তা।

উদ্যোক্তা সাবরিনা ইসলাম নারী উদ্যোক্তার দক্ষতা উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, লিঙ্গ বৈষম্য, এবং নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নারী ও শিশুদের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে আগ্রহী।

উদ্যোক্তা সাবরীনা ইসলাম ছোটবেলা থেকেই বাবার অনুপ্রেরণায় তার লেখা-লেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। ছেলেবেলা থেকেই লিখছেন। প্রথমে বিভিন্ন পত্রিকায় এবং পরে তার নিজের তোলা ছবি সহ বই তার প্রকাশিত হয়েছে। উদ্যোক্তা সাবরিনা ভ্রমণ ও ছবি তুলতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি তিনি একজন ফটোগ্রাফারও। খুব অল্প বয়স থেকে উদ্যোক্তা ছবি তুলতে ভালোবাসেন।

সাবরীনা ইসলাম তার উদ্যোক্তা জীবনে বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মোস্ট আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন অন্ট্রাপ্রেনর ইন এশিয়া, এসিআই অ্যাওয়ার্ড অ্যাজ আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন ইন করপোরেট সেক্টর, প্রাইড অব বাংলাদেশ, ডিএইচএল আউটস্ট্যান্ডিং উইমেন ইন বিজনেস ইত্যাদি।

উদ্যোক্তা সাবরীনা ইসলাম পাশাপাশি লিলি এপারেল্স লিমিটেড’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর, কনকর্ড গার্মেন্টস ও ওসমান ওসমান ইন্টারলাইনিং লিমিটেড’র পরিচালক। নারী উদ্যোক্তা সাবরীনা ইসলাম প্রথম থেকে বাংলাদেশের পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের উন্নয়নেও কাজ করে যাচ্ছেন।

সেখ মুসফেক –উস –সালেহীন
উদ্যোক্তা বার্তা, ঢাকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here