স্বপ্ন দেখতেন আর্কিটেক্ট হবেন। কিন্তু এইচএসসির পর পর হঠাৎ করেই , শখের বশে চারুকলায় ভর্তির কোচিং করেন। তারপর চারুকলার ক্যাম্পাস আর আর্টই বেশি ভালো লেগে গেলো মৈত্রীর।
নিজের যতটুকুই দক্ষতা ও সৌন্দর্য সৃষ্টির ক্ষমতা আছে তা দিয়ে মানুষের কাজে লাগে এমন কিছু করার উদ্দেশ্যে উদ্যোক্তা হয়ে উঠলেন তিনি। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক জিনিসপত্রকে কতটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়- সেটাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন। তাছাড়া হ্যান্ড পেইন্ট শাড়িকে আরো জনপ্রিয় করে তোলা যায় কিনা, এর জন্য কতটা অভিনব বিষয়, রঙ, রেখা ও স্টাইল প্রয়োগ করা যায়– এসব করার আনন্দেই তার উদ্যোগ ।
২০১৮ সাল থেকে শুরু মৈত্রীর উদ্যোগের। পেছনের গল্পটা জানাতে তিনি বলেন, “এখন যা আমি করি, তা করে আসছি ১৯৯৯ সাল থেকেই। আঁকতে ভালো লাগে, কিছু বানাতে ভালো লাগে তাই এসব করি। এবং গত পাঁচ ছয় বছর ধরে, আমাদের বাড়ির ওপর তলায় আমি ও আমার হাজবেন্ড একটা ওয়ার্কশপ বা স্টুডিও ধরণের জায়গা করেছি। আঁকা, মিউজিক প্র্যাকটিস, অবসরে নানা সৃজনশীল কাজে সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য । দু’জনে দুজনের মতো আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত থাকি, নানা বিষয়ে আলাপ করি, পড়ি, গান শুনি। আমাদের বাচ্চারাও এখানে যা খুশি করার স্বাধীনতা পায়। আমাদের একটা ইউটিউব চ্যানেলও আছে, সেখানে এসব দেখতে পারবে যে কেউ।”
কোভিডের দু’ বছর উদ্যোক্তা বাসাতেই থেকেছেন বেশি সময়। উদ্যোক্তা ও তার স্বামী প্রচুর সময় পেয়েছেন আঁকার। সেখান থেকেই মনে হলো তাদের স্টুডিওটাকে একটা বাণিজ্যিক রূপ দেবেন। তাই শাড়ি পেইন্ট দিয়ে তিনি উদ্যোগ শুরু করলেন। তাছাড়া জিন্সের ব্যাগ ডিজাইন, বাটিকের পর্দা, দেয়ালের জন্য তেল রঙের পেইন্টিং, হোম ডেকোরেশনের আনুষঙ্গিক অনেক কিছুই করলেন। অনলাইনে ভালো সাড়াও পেলেন।
কোভিডের শুরুতে অপেশাদার কিন্তু হ্যান্ডপেইন্টে আগ্রহী এমন কিছু মেয়েকে কোর্সও করিয়েছেন। তারা অনেকে মাত্র দু বছরেই অনেক দক্ষ হয়ে উঠেছেন।ভালোই কাজ করতে শুরু করেছেন তারা।
এখন উদ্যোক্তা মৈত্রীর বেশ সময় কাটে ওল্ড স্কুল আর্ট রুম নিয়ে। স্বপ্ন এই উদ্যোগকে আরও বড় করার।
মূলত হ্যান্ড পেইন্ট পোশাকই তিনি বেশি করেন। বাটিক, টাইডাই এসবও হয়। শিবুরি ডাই-এর সাথে হ্যান্ড পেইন্টের ফিউশন নিয়ে ওল্ড স্কুল আর্ট রুম প্রথম নিরীক্ষা করে। এখন বেশ ভালোই চলছে।
স্টিচ করা শাড়ি, কুর্তি, টপস – এসব ছাড়াও গৃহসজ্জার সব কিছু তৈরি করেন। ছোট ও বড় ক্যানভাস পেইন্টিং, জানালার পর্দা, বেড কাভার, কুশন কাভার, ব্যাগ ডিজাইন, ব্যাগে পেইন্টিং, মোট কথা যার উপর আঁকা যায় তা-ই করেন, এবং কিছু প্রডাক্ট ডিজাইনও করেন। পাশাপাশি অর্নামেন্টস ডিজাইন করেন। এখন ফ্লোর ম্যাট করার উদ্যোগও নিচ্ছেন।
উদ্যোক্তা জীবনের বাধা বলতে তিনি মনে করেন, সময় বের করতে পারাটা একটা বড় বাধা। যতটা সময় দেয়া দরকার ততোটা দিতে পারেন না। সংসার, আর্ট টিচার হিসেবে ব্যস্ততার পাশাপাশি এতো কাজ করে ওঠা একটা কঠিন ব্যাপার। তবে ম্যানেজ করে নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
আরেকটা বাধা ছিল: সেটা হলো পণ্যের ডেলিভারি।কিন্তু অনলাইন বিজনেস সারাদেশে যেভাবে বড় হচ্ছে তাতে ডেলিভারি ইন্ডাস্ট্রিও এখন অনেক ভালো হয়েছে।
তাদের কয়েকজন আর্টিস্টের টিম আছে। ৬ জন কর্মী দেশের কয়েকটি এলাকা থেকে তাদের সাথে কাজ করেন। এ ছাড়া নির্দিষ্ট কিছু দক্ষ টেকনিশিয়ান তারা রিসোর্সিং করেন। দেশের ভেতরে প্রায় সব জায়গায় পণ্য যায়। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতেই বেশি। দেশের বাইরে কানাডা , ইটালি, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাতেও অনেক অর্ডার ডেলিভার করেছেন। সামনে অস্ট্রিয়াতে একটা বড় ডেলিভারি যাচ্ছে তাদের।
উদ্যোক্তা জীবনে পরিবারের ভূমিকাই সবচেয়ে বড়। স্বামী-স্ত্রী দু জনে এখানে অনেকটা সময় দিতে পারার পেছনে তাদের দুজনের মায়ের ভুমিকা অনেক। তারাই বাচ্চাদের অনেকটা সময় দেন। তাই তারা তাদের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে পারছেন।
উদ্যোক্তা মৈত্রী জানান, তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা তো অনেক। উদ্যোগের প্রসার ঘটানো, হ্যান্ড পেইন্ট শাড়িতে নতুনত্ব আনা, জনপ্রিয় করে তোলা। আগামীতে একটা অন্যরকম শো রুম করার পরিকল্পনা আছে তাদের।
আর তাদের স্বপ্ন হচ্ছে দেশের প্রতিটি নারীর আলমারিতে একটা করে হলেও যেন ওল্ড স্কুল আর্ট রুমের শাড়ি থাকে। মানুষের বাড়ির দেয়ালে যেন তাদের পেইন্টিং থাকে।
তরুণদের জন্য পরামর্শ হলো,
“শিল্পের কাছাকাছি থাকুন।তাহলে পৃথিবীটা কঠিন মনে হবে না।আপনার শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটান আপনার কাজ দিয়ে। তাহলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে সাথে মানসিক প্রশান্তিও পাবেন।”
মাসুমা শারমিন সুমি
উদ্যোক্তা বার্তা