স্বামীর অসুস্থতা ও মৃত্যু, পারিবারিক বাধা, সমাজের চোখ রাঙানি: সব বাধা পেরিয়ে সফল তিনি

0
উদ্যোক্তা উম্মে হাবিবা

২০১২ সালে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চিকিৎসা এবং মেয়ের পড়াশোনার খরচসহ সংসার চালাতে উম্মে হাবিবা সিদ্বান্ত নিলেন ঘরে বসেই এমন কিছু করবেন যেন পরিবারে সময় দেওয়ার পাশাপাশি অর্থ উপার্জন সম্ভব হয়। সেই ভাবনা থেকে নিজের রান্নার দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে হোম মেড খাবার এবং ক্যাটারিং নিয়ে কাজ শুরু করেন উম্মে হাবিবা।

তার স্বামী একজন কম্পিউটার ব্যবসায়ী ছিলেন। ২০১১ সালে ব্যবসায়িক সমস্যার কারণে ব্যবসা, ফ্ল্যাট সব বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর থেকে ব্যাকবোনের সমস্যাও হয় তার। সঙ্গে আরও কিছু শারীরিক জটিলতা। এ কারণে বাসাতেই থাকতে হতো তাকে। সেসময় হাবিবা একটি প্রাইভেট ফার্মে কর্মরত ছিলেন। জবে থাকার কারণে পরিবারে ঠিকমতো সময় দিতে পারছিলেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন বাসায় থেকেই আয়ের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

শখের বশে একসময় রান্না শিখেছিলেন তিনি। রান্নায় পারদর্শী হওয়ায় রান্না নিয়ে কিছু একটা করার জন্য সবাই পরামর্শ দিলেন। ২০১৩ সালে স্বামীর অসুস্হতায় সংসারের হাল ধরতে উদ্যোক্তা জীবন বেছে নেন। চাকুরি করলে বাসায় সময় দেয়া যায় না তাই বাসায় বসে ইনকাম করে সংসার চালানোর উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেন। এক ছোট ভাইয়ের মাধ্যমে মজিলা ফায়ারফক্সের একটি ইভেন্টের কাজ পান। বেশ প্রশংসা পায় তার রান্না। একের পর এক অর্ডার আসতে থাকে।

প্রথম অর্ডারের সময় কোন পুঁজি ছিলো না তার। অ্যাডভান্স নিয়ে বাজার করে ইভেন্টের জন্য রান্না করেন। তিনমাস পর নিজের ১০ হাজার টাকার সাথে আরো ১০ হাজার ধার করে একটি ফুড কার্ট দেন। এক বছরের মধ্যে এক লাখ টাকা লাভ হয় সেখান থেকে। সেই টাকা দিয়ে ডিপ ফ্রিজ, নরমাল ফ্রিজ, ২০ ও ৩০ কেজির বড় পাতিলসহ জরুরি জিনিসপত্র কিনে ক্যাটারিং কিচেন সাজান হাবিবা৷ বর্তমানে তার সাথে চারজন কর্মী পার্ট টাইম কাজ করছেন।

তিনি মূলত শাহী খাবার নিয়ে কাজ করেন। বিয়ের আয়োজনে ১০০ থেকে ২-৩ হাজার লোকের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকেন। তার আইটেমের মধ্যে থাকে জাফরানি পোলাও, মোরগ পোলাও, বিরিয়ানি, মান্দি, বুন্দিয়া পোলাও, কাচ্চি, বিভিন্ন রকমের রেজালা, রোষ্ট, কাবাব, মাছের বিভিন্ন আইটেম। ডেজার্টে রেশা ফিরনি, নরমাল ফিরনি, শাহী টুকরা, জর্দ্দা, দিলবাহার, মুজ। এছাড়া বোরহানি, লাবাং, বাদামের শরবত আছে। স্পেশাল আইটেমে থাকে দইবড়া। তার সিগনেচার ডিস দিলবাহার পাওয়া যায় হাবিবার জে কে ক্যাটারিং-এ।

কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, সৌদি আরবের অনেকে ফ্রোজেন করে তার খাবার বহুবার লাগেজে করে নিয়ে গেছেন। তবে ঢাকার সব জায়গায় তার পণ্য যাচ্ছে। মাসে অর্ডারের উপর ভিত্তি করে ৩০ হাজার থেকে প্রায় লাখ টাকার মত আয় হয় তার।

২০২০ সালে ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ ধরা পড়ে তার স্বামীর। আটটি কেমোথেরাপি দেওয়ার পর ২০২১ সালে মারা যান তিনি। সেসময় মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন হাবিবা। প্রায় নয় মাস কোন কাজ করতে পারেননি। কিন্তু দুই মেয়েকে মানুষ করতে হবে এই ভেবে আবার শুরু করেছেন তার উদ্যোক্তা জীবন। 

উদ্যোক্তা উম্মে হাবিবা বলেন: আমি সফল কিনা জানি না,  রিন সফল নারী হিসেবে পুরস্কার পেয়েছি। আমার শুরুটা হয়েছিল অনেক কষ্টের মাঝে, টিকে থাকাটা সহজ ছিল না। শুরুতে পারিবারিক অনেক বাধা ছিল। প্রতিষ্ঠিত পরিবারের সন্তান হয়েও কেন আমাকে রান্না করে খাবার বিক্রি করতে হবে, এটার জন্য অনেক জবাবদিহিতা করতে হয়েছে। পরিবারের অনেকের সম্মানে লাগতো আমার এই বিষয়টি। তবে একজন নারী হয়ে স্বামীর চিকিৎসা, সংসারের হাল যখন সফলভাবে পালন করতে পারলাম এবং চারদিকে যখন আমার খাবারের প্রশংসা শুরু হয়েছিল, তখন সবার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। যারা আমার পেশাকে ছোট করে কথা বলতো আজ তারা কথা বলে খুব হিসেব করে। এটা বেশ ভালো লাগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, আমার বাবার বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি, তার সম্মান রক্ষা করতে পেরেছি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জে কে ক্যাটারিং একদিন অনেক বড় ব্রান্ড হবে। নিজস্ব পার্টি সেন্টার করার খুব ইচ্ছে আছে আমার।’

পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম উম্মে হাবিবার। সেখানেই কাটে তার শৈশব। উইমেন ফেডারেশন কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে নিজ উদ্যোগে কাজ শুরু করেন। দুই মেয়েকে সাথে নিয়ে তিনি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শাহী খাবার নিয়ে জে কে ক্যাটারিং-কে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

সেতু ইসরাত
উদ্যোক্তা বার্তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here